এস এম মিন্টু ও মিনারুল হক
বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘ এক মাস অভিযান চালিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) একটি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গতকাল বুধবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এ তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রুমা উপজেলায় গত ২৫ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। এ সময় সেনাবাহিনীর টহলদল সীমান্তবর্তী জনবসতিহীন এলাকায় তথাকথিত বম পার্টির (কেএনএ) একটি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি চিহ্নিত করে। পরে সেখানে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কাঠের রাইফেল, স্নাইপার অস্ত্রের সিলিং, মিলিটারি বেল্ট, কার্তুজ বেল্ট, পোচ, ইউনিফর্ম, বুট, কম্বল, ওয়াকিটকি চার্জার, সোলার প্যানেল, রসদ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এ ছাড়া সশস্ত্র সংগঠনটির প্রশিক্ষণ মাঠ, ফায়ারিং রেঞ্জ, পরিখা এবং বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনা দখলে নিয়েছেন সেনা সদস্যরা।
আইএসপিআর আরো জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে সব জাতিগোষ্ঠীর জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর এবং ভবিষ্যতেও সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এর আগে, গত ৩ জুলাই রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পাইন্দু ইউনিয়নের পলিপাংসা-মোয়ালপিয়র তাইনদাংঝিরি এলাকায় সেনাবাহিনীর অভিযানে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) কমান্ডার লাল মিন সাং (পুতিন) নিহত ও তিনজন আহত হন। ওই অভিযানে তিনটি এসএমজি, একটি রাইফেল, অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়।
এদিকে স্থানীয় সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পর গত বছর কেএনএ আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মিজোরামের অভ্যন্তরে চলে যায়। হারানো শক্তি ফিরে পেতে গত দুই মাস আগে থেকে জোর করে বাড়ি থেকে কিশোর-তরুণদের ধরে নিয়ে গিয়ে কেএনএ সন্ত্রাসীরা উঁচু পাহাড়ের ওপর গহিন জঙ্গলে ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। সেখানে শুরু হয় শারীরিক কসরত। কমব্যাট ট্রেনিং নিতে হয়। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করে তারা। উঁচু পাহাড়ের ওপর ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে কখনো কখনো গুলির শব্দ পাওয়া যায়। দুই পাহাড়ের ভাঁজে বসবাস করা পাহাড়ি-বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, ওখানে ট্রেনিং হচ্ছে। এভাবেই ট্রেনিং সম্পন্ন করার পর তারা পরিধান করে জলপাই রঙের অ্যাম্বুস প্রকৃতির ছাপা শার্ট-প্যান্ট, ক্যাপ ও জ্যাকেট। পায়ে থাকে বুট জুতা। তাদেরকে সেনাবাহিনীর আদলে পদবি দেয়া হয় ক্যাপ্টেন, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং কর্নেল। এই ট্রেনিং ক্যাম্পটি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মিদের (কেএনএ)।
সূত্র আরো জানায়, প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে সেখানে বান্দরবানের মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী তিন উপজেলায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী অস্ত্রভাণ্ডার। সীমান্তবর্তী পার্বত্য বান্দরবানের তিনটি উপজেলা রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে ধীরে ধীরে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কেএনএ। তাদের অস্ত্র জোগান দিচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠীর সদস্যরা। সেখান থেকেই অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে এই গোষ্ঠী। আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে অস্ত্র বিনিময়, কেনাবেচা এবং হাতবদলের মাধ্যমে নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে এম-২২, এম-১৬ এবং একে-৪৭ রাইফেল স্টিলবাট ভার্সনের। এছাড়াও স্নাইপারের গুলি উদ্ধার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারণা করছে, তাদের কাছে স্নাইপার রাইফেল রয়েছে। এরই মধ্যে তারা আরাকান আর্মিদের কাছ থেকে এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় শীর্ষ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। একে-৪৭ রাইফেল, গ্রেনেড, রকেট লঞ্চার, লাইট মেশিনগান, রকেট প্রপেলড গ্রেনেড, কমিউনিকেশন ডিভাইস ও নাইট ভিশন প্রযুক্তির অস্ত্রের একটি বড় অংশ মিয়ানমারের চিন (শিন) রাজ্য, কাচিন, রাখাইন ও সাগাইং অঞ্চলে সামরিক জান্তার ঘাঁটি থেকে আরাকান আর্মিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আরাকান আর্মিদের কাছ থেকে কেএনএ এসব অস্ত্র সংগ্রহ করছে।
স্থানীয় সূত্র ও গোয়েন্দা তথ্য বলছে, কেএনএ দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবানের আধিপত্য হারিয়ে পলাতক ছিল। তারা এক দিকে শক্তি বাড়াতে ভারী অস্ত্রের মজুদ করছে অন্যদিকে প্রশিক্ষণের পর বান্দরবানের চাঁদাবাজি, শক্তিশালী দলগঠন করে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার রোয়াংছড়ি উপজেলা বর্তমানে কুকি-চিনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। মিজোরাম সীমান্ত থেকে অস্ত্র এনে এই এলাকার মাধ্যমে রুমা ও থানচিতে পাঠানো হয়। রাতের আঁধারে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে করে অস্ত্রের চালান নেফিউ পাড়া, বাকলাই, তাজিংডং, কেওকারাডং, বগালেক হয়ে রুমার বিভিন্ন পাহাড়ে কেএনএয়ের ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কিছু স্থানীয় সহযোগী এই কাজে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বম সম্প্রদায়ের বেশ কিছু বিপথগামী যুবক নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ গড়ে তোলে। এদের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট, অপহরণ হত্যা চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে এই সশস্ত্র দলটি রুমা ও থানচি উপজেলায় দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালিয়ে টাকা ও অস্ত্র লুট করে।