ই-ব্যাংকিং পরিসংখ্যানে স্থবিরতা নতুন কোনো সঙ্কেত?

ব্যাংকিং খাতের ডিজিটাল রূপান্তরে ‘অদৃশ্য হাত’

২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে, তবে বিস্তারের এই সংখ্যাগত সাফল্য ব্যাংকিং খাতের মূল সঙ্কটগুলো সমাধান করতে পারেনি। দুই বছরে মোট ব্যাংক শাখা প্রায় ১০৭১টি বৃদ্ধি পেলেও, ডিজিটাল ব্যাংকিং কাঠামোর উন্নতি, গ্রাহকসেবা, সাইবার নিরাপত্তা, ক্রেডিট গভর্নেন্স বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় খুব একটা অগ্রগতি চোখে পড়ে না- এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-ব্যাংকিং ও ই-কমার্স পরিসংখ্যান বলছে- দেশের ব্যাংক শাখাগুলো প্রায় পুরোপুরি অনলাইনে চলে গেছে। কিন্তু সংখ্যাগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা: দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘পূর্ণ অনলাইন’ শাখার সংখ্যা বাড়ছে কচ্ছপের গতিতে, ‘আংশিক অনলাইন’ কিংবা ‘অফলাইন’ শব্দ দুটো পুরোপুরি অদৃশ্য!

এই অস্বাভাবিক সরলীকরণই আজ কেন্দ্রে আসছে, কারণ ডিজিটাল ব্যাংকিং অবকাঠামো নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে- আরটিজিএস-সুইফট ইন্টিগ্রেশন, ডেটা হোস্টিং, ফায়ারওয়াল ক্রয়, তথ্য নিরাপত্তা এবং সবচেয়ে আলোচিত আইসিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোপন সিন্ডিকেট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-ব্যাংকিং এবং ই-কমার্স পরিসংখ্যান ইউনিট থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ ব্যাংক শাখার পরিসংখ্যান বলছে- ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে, তবে বিস্তারের এই সংখ্যাগত সাফল্য ব্যাংকিং খাতের মূল সঙ্কটগুলো সমাধান করতে পারেনি।

দুই বছরে মোট ব্যাংক শাখা প্রায় ১০৭১টি বৃদ্ধি পেলেও, ডিজিটাল ব্যাংকিং কাঠামোর উন্নতি, গ্রাহকসেবা, সাইবার নিরাপত্তা, ক্রেডিট গভর্নেন্স বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় খুব একটা অগ্রগতি চোখে পড়ে না- এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে খাতসংশ্লিষ্টরা।

শাখা বৃদ্ধির গতি: সংখ্যায় উন্নতি, বাস্তবতায় চাপ

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেখানে শাখা সংখ্যা ছিল ১১,১৫২, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১,৩৮৮। অর্থাৎ- ২ বছর ৭ মাসে শাখা বৃদ্ধি: ২৩৬টি। গড়ে মাসে নতুন শাখা: প্রায় ৭টি।

এ বৃদ্ধি স্বাভাবিক ও ধীরগতির হলেও এটি দেখায় ব্যাংকিং শিল্প এখনো শারীরিক উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- সেবার মান কি বেড়েছে? নাকি শুধু সংখ্যাই বেড়েছে? একতরফা ‘পূর্ণ অনলাইন’ পরিসংখ্যান: বাস্তব নাকি সাজানো?

২০২৩ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সব শাখা-শহর ও গ্রাম মিলে- একটিও ‘অফলাইন’ বা ‘পার্শিয়ালি অনলাইন’ দেখানো হয়নি। এটি শুধু অস্বাভাবিকই নয়; ব্যাংকিং প্রযুক্তিবিদদের ভাষায়, ‘টেকনিক্যালি ইমপসিবল।’

কারণ- দেশে ব্যাংকগুলো এখনো একাধিক পুরনো কোর ব্যাংকিং সিস্টেম (সিবিএস) ব্যবহার করছে, গ্রামীণ অঞ্চলে নিয়মিত সার্ভার-ডাউন, অপটিক্যাল ফাইবারে বিঘ্ন, বিদ্যুতের লোডশেডিং, ভৌগোলিক বৈচিত্র্যে নেটওয়ার্ক কাভারেজ বৈষম্য রয়েছে।

একজন সাবেক আইসিটি পরামর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিসংখ্যানে হয় অবহেলা আছে, নয়তো সচেতনভাবে বাস্তবতা আড়াল করা হয়েছে। উভয়টাই বিপজ্জনক।’

‘স্থবির’ অনলাইনিং গ্রোথ- ডিজিটাল ব্যাংকিং কি থেমে গেছে?

ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়- জুলাই ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত পুরোপুরি অনলাইন শাখা বেড়েছে মাত্র ১৭১টি। বছরের পর বছর ‘গ্রাফ’-এর লাইন একই সরু ঢালে। এমন স্থবিরতার ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারছেন না। যদি সব শাখা অনেক আগেই অনলাইন হয়ে থাকে, তবে- নতুন প্রযুক্তি কোথায়?

ইন্টারঅপারেবিলিটি অগ্রগতি কোথায়?

প্রশ্ন উঠেছে- সাইবার-ডিফেন্সে বিনিয়োগ কোথায় প্রতিফলিত হচ্ছে? স্মার্ট ব্যাংকিং অ্যাকশন-প্ল্যানের ফলাফলে কোনো আপডেট আছে?

ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞদের মতে- ‘ডেটায় স্থবিরতা মানে পলিসিতে স্থবিরতা- অথবা প্রতারণা।’

কী লুকানো হচ্ছে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখানেই

অনেকে বলছেন- ই-ব্যাংকিং পরিসংখ্যানকে যতটা সম্ভব ‘গুছিয়ে’ দেখানো হচ্ছে একটি বড় কারণের জন্য: ব্যাংক খাতে ডেটা-কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সঙ্ঘাত।

অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে- আইসিটি বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে একটি ‘অঘোষিত চেইন অব কমান্ড’ কাজ করত, তারা সিবিএস আপগ্রেড থেকে ফায়ারওয়াল ক্রয়- সব জায়গায় কমিশনভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে,

ডেটা অডিট ও সাইবার-ইনভেস্টিগেশন প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ট্রানজিশন সরকারের আগেও এ সিন্ডিকেট অপারেশনাল ছিল।

২০২৪ সালের রিজার্ভ হ্যাক তদন্তের সময় তথ্য লুকানো নিয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল- যা এখনো পুরোপুরি তদন্ত শেষ হয়নি।

একজন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন- ‘ব্যাংক শাখার অনলাইন-অফলাইন স্ট্যাটাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে ডেটা ম্যানিপুলেশন অপরিহার্য। সত্যিকারের ই-ব্যাংকিং ডেটা প্রকাশ পেলে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, টেকনিক্যাল রিস্ক, এমনকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোপনীয়তাও ধরা পড়ে যেত।’

রিজার্ভ হ্যাক-পরবর্তী প্রশ্ন : আমাদের ই-ব্যাংকিং সিস্টেম নিরাপদ তো?

২০২৫ সালে এসে যখন- সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন পেরিয়েছে কোটি কোটি ডলারের সীমা, ডিজিটাল ফিন্যান্স নিয়ে আরো বড় রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে, তখন ই-ব্যাংকিং পরিসংখ্যানে স্বচ্ছতা না থাকা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: অনলাইনিং স্ট্যাটাস গোপন করা হচ্ছে কি ঝুঁকি লুকাতে? নাকি ব্যাংকিং সিস্টেমের বহু লুকানো ‘ডেড-জোন’ রয়েছে যা প্রকাশ করতে চায় না কেউ? প্রতিটি ব্যাংকের প্রকৃত প্রস্তুতি রিপোর্ট কোথায়? নেটওয়ার্ক ডাউনটাইম ম্যাপ কেন প্রকাশ করা হয় না? শাখাভিত্তিক সাইবার ঝুঁকি স্কোরিং কেন লুকানো?

সিন্ডিকেটের পুরনো ছায়া : আইসিটি ডিপার্টমেন্ট কি এখনো ‘ক্লিন’ হয়নি

এ প্রশ্ন উঠছে কারণ- একাধিক বড় ব্যাংক এখনো পুরনো সিবিএস-এর ওপর নির্ভরশীল, ডেটা লিকের একাধিক ঘটনা চাপা পড়েছে, ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রোজেক্টে অস্বাভাবিক দেরি হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ বারবার ‘টেকনিক্যাল ইনফরমেশন’ চাইলে তা দেরিতে দেয়া হচ্ছে।

অনেকে মনে করছেন- অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট এখনো ভেঙে যায়নি, কেবল নীরবে অবস্থান পরিবর্তন করেছে।

সর্বোপরি সংখ্যার পেছনের নীরবতার তদন্ত প্রয়োজন। ই-ব্যাংকিং পরিসংখ্যান যতটা ডিজিটাল অগ্রগতির গল্প, তার চেয়েও বেশি গোপন ঘরে কী ঘটছে তার ইঙ্গিত বহন করে। আজ পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম অনলাইন- এমন দাবি শুধুই ‘আধুনিকতার বিজ্ঞাপন’ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা যদি ভিন্ন হয়, তবে তা দেশের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একটি বিপর্যয়কর হুমকি।

বিশেষজ্ঞদের মতে,এখন প্রয়োজন- স্বাধীন ডিজিটাল অডিট, শাখাভিত্তিক রিয়েল-টাইম ডেটা প্রকাশ, আইসিটি ডিপার্টমেন্ট পুনর্গঠন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- ডেটা ম্যানিপুলেশনের সম্ভাব্য সব উৎস শনাক্ত ও বিচ্ছিন্ন করা। কারণ একটি প্রশ্নই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ: ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর এই ‘চমৎকার’ পরিসংখ্যান- এটা কি সত্যি, নাকি নতুন কোনো কারসাজির জন্য পর্দা?