গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে ঘেরা কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর যেন এক অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের ভাণ্ডার। যুগে যুগে নির্মিত শৈল্পিক স্থাপত্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এ অঞ্চল এখন পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় ভ্রমণস্থল। এরই মধ্যে গোবিন্দপুর ইউনিয়নে অবস্থিত গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি এবং জমিদারপুত্র মানব বাবুর বিশাল মাছের খামার জনপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই এখানে ভিড় করেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা।
জমিদার বাড়ির শেষ বংশধর শ্রী মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী মানব বাবু এখনো বাড়িটিতে বসবাস করেন। তার সাথে কথা বলার সুযোগ পাওয়া পর্যটকদের কাছে এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জমিদারি প্রতিষ্ঠা, বিলুপ্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে তার কাছ থেকেই জানতে পারেন দর্শনার্থীরা। ফলে বাড়িটির প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ আরো বাড়ছে। ইতিহাসবিদ ও হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যাপক এম এ হাকিম জানান, মানবেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শাস্ত্রীয় পণ্ডিত। ১৬ শতক থেকেই তারা শিবমন্দির এলাকায় বসতি গড়েন। পরবর্তীতে ১৮ শতকের শেষ দিকে দীননাথ চক্রবর্তীর হাত ধরে জমিদারি যাত্রা শুরু হয়। দীননাথ ইংরেজদের কাছ থেকে হোসেনশাহী পরগণার কিছু অংশ ক্রয় করেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম বাবু অতুল চক্রবর্তী ‘পত্তনি’ সূত্রে গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি যুক্ত করেন।
১৮ শতকের গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই জমিদারবাড়িটি এক অনন্য নিদর্শন। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে ভরা কাচারি ঘর, নহবতখানা, দরবারগৃহ ও মন্দির ঘিরে রয়েছে সুউচ্চ প্রাচীর। বিশাল বাগান আর পুকুরসহ প্রায় ৯.৮৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ বাড়িটি এখনো অতীত ঐশ্বর্যের স্মৃতি বহন করছে। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে মানব বাবুর পরিচালিত নয়নাভিরাম বিশাল মাছের খামার পর্যটকদের আকর্ষণ আরো বাড়িয়েছে। মানব বাবু জানান, তাদের পূর্বপুরুষ ভূপতিনাথ চক্রবর্তী ব্রিটিশ আমলে ধর্মকর্ম করতে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থে জমিদারির কিছু অংশ ক্রয় করেন। সে সময় খাজনা আদায়ে ব্যর্থ হলে জমিদারি বাতিল হওয়ার নিয়ম থাকায় জমিদারেরা কঠোর হতে বাধ্য হতেন। এই কঠোরতার কারণেই শেষ পর্যন্ত জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম মবিন বলেন, জমিদারি প্রথা না থাকলেও গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি নতুন প্রজন্মকে অতীত ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করছে। তার মতে, গ্রিক স্থাপত্যশৈলী, ঐতিহাসিক মূল্য ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশের কারণে গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি এখন জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। হোসেনপুরের অতীত ঐতিহ্য জানতে এবং চোখে দেখে অনুভব করতে প্রতিদিনই ছুটে আসছেন হাজারো দর্শনার্থী। গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি তাই শুধু স্থাপত্য নয় এ অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য প্রতিচ্ছবি।



