সাত খামারে ৩ হাজারের বেশি ছাগল
- ৯ জেলার ৪৬ উপজেলায় পাইলট প্রকল্প গ্রহণ
- তিন বছরে প্রকল্পের খরচ ৩০.৫৩ কোটি টাকা
বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা জাতের ছাগল হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু আন্তঃপ্রজনন, অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা, উন্নত খামার ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাময় ছাগলের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ইনব্রিডিং, উন্নত খামার ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের কৌলিক গুণাগুণ, বিশেষ করে প্রজনন সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ভারতে জাতীয় গোশত উৎপাদনে ছাগলের অবদান ১৩.৭২ শতাংশ। আর বাংলাদেশে মাত্র ৩.১৯ শতাংশ। বর্তমানে দেশে সাতটি ছাগলের খামারে মোট তিন হাজার ১৩৮টি ছাগল রয়েছে। যাতে ধারণক্ষমতা হলো সাড়ে ৭ হাজারের বেশি। আর সংকরায়ন ও আন্তঃপ্রজনন প্রতিরোধের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে পাইলটিং এ বিশুদ্ধ জাতের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ও দেশীয় ভেড়া সম্প্রসারণে পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রের তথ্য হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আয়বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। সার্বিক কৃষিখাতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং আত্মকর্মসংস্থানে প্রাণিসম্পদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত হাইস-২০২২ এর তথ্যমতে দেশে মোট গোশত কনসাম্পশনে গরু ২৯.১১ শতাংশ, ছাগল ৩.১৯ শতাংশ, পোল্ট্রি ৬৫.৩৪ শতাংশ ও অন্যান্য উৎসের অবদান ছিল ২.৩৬ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সাতটি ছাগলের খামার রয়েছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ছাগল উন্নয়ন খামার, সাভার। এরপর ১৯৯০ সালে রাজশাহীতে, ১৯৯১ সালের সিলেটে, ১৯৯৬ সালে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ২০০৭ সালে স্থাপন করা হয়। এই সাতটিতে ৫৮টি শেডে মোট তিন হাজার ১৩৮টি ছাগল রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে সাভারে এক হাজার ২৩টি। সবগুলোয় ছাগল পালনের ধারণক্ষমতা হলো ৭ হাজার ৫৮০টি। চট্টগ্রাম ও বরিশালে জনবল নেই। অন্যগুলোয় জনবল পর্যাপ্ত না। প্রকল্প এলাকা হলো, ঢাকার সাভার, ধামরাই, কেরাণীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার (পিআইউসহ), রাজশাহীর পবা, দুর্গাপুর, মোহনপুর, চারঘাট, পুঠিয়া, বাঘা, গোদাগাড়ী, তানোর, বাগমারা, বগুড়ার শেরপুর, যশোরের যশোর সদর, মনিরামপুর, অভয়নগর, বাঘারপাড়া, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, কেশবপুর, শার্শা, মেহেরপুরের মেহেরপুর সদর, গাংনী, মুজিবনগর, চুয়াডাঙ্গার চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, জীবননগর, কুষ্টিয়ার কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর, দৌলতপুর, ভেড়ামারা, মাগুরার মাগুরা সদর, শালিখা, মহম্মদপুর, শ্রীপুর, ঝিনাইদহের ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর উপজেলা।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুসারে, ছাগলের সংখ্যা, গোশত ও দুধ উৎপাদনের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। বিশেষ করে ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং গোশত উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। খামার ব্যবস্থাপনায় প্রণোদনা প্রদান এবং সরকারি নীতিগত সহায়তা অব্যাহত থাকলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করেও ছাগলের গোশত এবং চামড়া রফতানি সম্ভব। বিশ্বের অন্যতম সেরা ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগলের আবাসস্থল বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের, মূল্যায়ন অনুসারে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দ্রুত প্রজননশীলতা (বছরে ২ বার), অধিক বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা, অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, সুস্বাদু গোশত, আন্তর্জাতিকমানের চামড়া ও জলবায়ু সহনশীলতার জন্য প্রসিদ্ধ। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দ্রুত বয়োঃপ্রাপ্ত হয় এবং একই সময়ে রামছাগলের (যমুনাপারি) তুলনায় ২ থেকে ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি বাচ্চা জন্ম দেয়।
প্রকল্পের কার্যক্রম হলো, দেশের বিভিন্ন স্থান ও সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে অধিক উৎপাদনশীল ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বাছাই করে সুবিধাজনক একটি খামারে (কেন্দ্রীয় প্রজনন খামার হিসেবে ব্যবহৃত) পালন করা হবে। সিলেক্টিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে নিউক্লিয়াস হার্ড গঠিত হবে। নিউক্লিয়াস হার্ডের প্রতিটি প্রাণীর পরিচিতি নম্বর, জন্ম ইতিহাস, উৎপাদন, স্বাস্থ্যগত এবং পুনরুৎপাদনসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্রিডিং ভ্যালু নির্ণয়পূর্বক প্রজনন কাজে ব্যবহারের জন্য প্রাণী বাছাই এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রজননের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় প্রাণীর কৌলিকমান উন্নয়ন করা হবে। হার্ড থেকে অধিক উৎপাদনক্ষম প্রাণীর সিমেন খামারি পর্যায়ে ব্যবহার করে দেশব্যাপী ছাগলের কৌলিক মান উন্নয়ন করা হবে। এ পদ্ধতিতে কৌশলগত কারণে প্রতি বছর নিউক্লিয়াস হার্ড থেকে কিছু প্রাণী ছাঁটাই করা হবে এবং খামারি পর্যায় থেকে কিছু অধিক উৎপাদনক্ষম প্রাণী নিউক্লিয়াস হার্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে ইনব্রিডিং সমস্যা ঠেকাতে সর্বোচ্চ ব্রিডিং ভ্যালু বিশিষ্ট পাঁঠাগুলোর (১০টি) বীজ সরবরাহ করা হবে না। এ পাঁঠাগুলোর বীজ/সিমেন নিউক্লিয়াস হার্ডের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হবে। ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন সেবা নির্বাচিত জেলাগুলোতে সম্প্রসারণে বিদ্যমান কৃত্রিম প্রজনন ল্যাব ফ্যাসিলিটি, সরবরাহ নেটওয়ার্ক ও এআই টেকনিশিয়ানদের ব্যবহার করা হবে। সুতরাং খামারীর দোরগোড়ায় ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন সেবা সম্প্রসারণে সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারগুলোর আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা উন্নয়ন এবং পালনে আগ্রহ সৃষ্টি করা হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিকল্পনা শাখা বলছে, এই জাতটি সংরক্ষণে মন্ত্রণালয় ৩০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন বছরের জন্য প্রকল্প নিয়েছে। সংকরায়ন ও আন্তঃপ্রজনন প্রতিরোধের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে পাইলটিং, ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সরকারি খামারে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির পরিমার্জনই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।