- কমছে জীববৈচিত্র্য
- নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ
- বিষাক্ত হয়ে পড়ছে পানি
- মিশছে মানববর্জ্য
টাঙ্গুয়ার হাওরে রাতে রঙিন বাতির সাথে উচ্চশব্দে চলে ডিজে পার্টি। পানিতে ভাসে প্লাস্টিক, পলিথিন মানববর্জ্য। এসবে জীববৈচিত্র্য হ্রাসে হিজল, করচ, বরুণ, শালুক ও শাপলার মতো জলজ উদ্ভিদ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার মধ্যেও সবুজ করচগাছ আর স্বচ্ছ পানির সাথে হাউজবোটগুলোই চষে বেড়ায় গোটা হাওর। কিন্তু মানব অত্যাচারে দেশের জীবন্ত জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার ধীরে ধীরে ভয়ানক পরিণতির দিকে যাচ্ছে তার খোঁজ কেউ রাখছে না। ফলে হাওরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে নিকেল, ক্রোমিয়াম, সিসা, জিঙ্ক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজের মতো ক্ষতিকারক ভারী ধাতু। এ অবস্থায় জীবন শঙ্কায় কাঁদছে জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার টাঙ্গুয়ার হাওর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক, পলিথিন, মানব ও হাউজবোটের বর্জ্য, শব্দদূষণ, ভারী ধাতুর উপস্থিতি হাওরের পরিবেশের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলছে। যার কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও হাওরের পানি ও পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, জেনারেটর, উচ্চশব্দে গান বাজানো এবং ডিজে পার্টির কারণে হাওরের জীবজন্তু, পাখি এবং জলজ উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাঁতারে গাছের গোড়ায় নেমে ছবি তোলা, নৌকার প্রপেলারে গাছপালা কেটে যাওয়ায় জলজ বৃক্ষরাজি নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় হাওর ক্ষতিগ্রস্তের সাথে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। হাওরের পানিতে নিকেল, ক্রোমিয়াম, সিসা, জিঙ্ক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজের মতো ক্ষতিকারক ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণরোধে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিষিদ্ধ, প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে তারা বলেন, নয়তো এক সময় এ হাওরের মৃত্যু ঘটবে। আর স্থানীয় প্রশাসন বলছে, হাওর রক্ষায় তারা কঠোর হচ্ছেন। শিগগিরই এ বিষয়ে অভিযানে নামবেন।
পরিসংখ্যান বলছে শব্দদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য, বিষটোপ এবং খাদ্যের অভাবে বর্তমানে এখানে পাখি, মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গেছে। ১৮ সালে এ হাওরে প্রায় ৬০ হাজার পাখি ছিল। এরপর মাত্র পাঁচ বছরে ২৩ সালে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৩ হাজারে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে পাখি ৬২ শতাংশ কমে ৩৭ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের তথ্য মতে, এক সময় শীতে এ হাওরে প্রায় পাঁচ লাখ অতিথি পাখি এলেও ২৫ সালের শুমারিতে দেখা যায় তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৩ হাজারে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক হাউজবোটে হাওরে শতকরা দু’শ পর্যটক অবস্থান করেন। এতে করে হাওরের পানিতে দিনে শুধু মানববর্জ্য ফেলা হয় প্রায় দুই শ’ কেজি। তার সাথে মানুষের খাবার উপকরণ প্লাস্টিকসহ অসংখ্য ক্ষতিকর উপাদান ফেলা হয়। সেই সাথে চলে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাখি, মাছের প্রজনন। এলাকা ছেড়ে চলে গেছে দেশী বিদেশী পাখি ও মাছ। সেই সাথে বিলীন হচ্ছে হিজল গাছ।
মাছের বিলুপ্তি নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, এক সময় ‘মাদার ফিশারি’ নামে পরিচিত এ হাওরে আগে ১৪১ প্রজাতির দেশী মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে তাতে ৮৩ প্রজাতির বিলুপ্তি হয়ে এখন মাত্র ৫৮ প্রজাতি অবশিষ্ট রয়েছে।
অন্য দিকে সিলেট অ্যাগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির অ্যাকুয়াটিক রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তথ্যানুযায়ী, হাওরে ‘নিষিদ্ধ জাল, অতিরিক্ত শিকার, পানিদূষণ ও পর্যটকবাহী হাউজবোটের কারণে প্রজনন ধ্বংস হচ্ছে। শুধু মাছ নয়, পাখিরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত একটি যৌথ গবেষণায় (নোবিপ্রবি, বুয়েট ও বিসিএসআইআর) টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় নিকেল, সিসা, জিংক, ক্রোমিয়াম, তামা ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। গবেষকদের মতে, এসব ভারী ধাতুর উৎস ভারতীয় কয়লাখনি নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য, কীটনাশক এবং হাউজবোটের বর্জ্য। এতে করে পানির মাধ্যমে মাছ ও মানুষ- দু’পক্ষই চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। ভারী ধাতুর দূষণ মাছে জমা হয়। সে মাছ খেলে প্রাণঘাতী ক্যান্সারও হতে পারে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, পয়বর্জ্য ও উচ্চস্বরে মিউজিকের বিষয়ে তারা অবগত। এ পর্যন্ত একাধিক অভিযানে উচ্চস্বরে বাজনা অনেকটা বন্ধ হয়েছে। তবে নিজেদের নৌকা না থাকায় রাতে যে সময়ে এমন কার্যকলাপ চলে সে সময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তারপরও সামর্থ্যরে মধ্যে যা আছে তা নিয়েই তা বন্ধের চেষ্টা চলছে। আর পয়বর্জ্য বন্ধে তারা কঠোর হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সব নৌকার মালিকদের এ বিষয়ে রির্জাভ ট্যাঙ্কিতে ময়লা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা না মানলে প্রশাসন কঠোর হবে।
অপর দিকে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মেহেদী হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমি মাত্র জয়েন করেছি। হাওরের পরিবেশ রক্ষায় করণীয় নিয়ে হাউজবোট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে এ নিয়ে কথা বলব। যদি তারা নির্দেশনা না মানেন তবে টাস্কফোর্স অভিযান চালিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
প্রশাসনের তথ্য মতে, সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। এতে ছোট বড় ১০৯টি বিল আছে। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার। এতে ইজারাদারির অবসান হয়। এরপর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি ‘রামসার সাইট’ বা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হাওরের জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় হাওরটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন টাঙ্গুয়ার হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।