ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগসহ দেশের ৬৮ কারাগারের ভেতরে ও বাইরে স্থাপন করা মনিটরগুলো দীর্ঘদিন ধরেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব মনিটরের ডিসপ্লের মাধ্যমেই আটক কারাবন্দী ও তাদের স্বজনরা জানতে পারতেন, তাদের প্রিয় মানুষটির অবস্থান কোথায় রয়েছে আর কবে নাগাদ কারাগার থেকে মুক্ত হবে। কারা অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত এই প্রকল্প শেষ করতে সরকারের কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। তারপরও কিভাবে প্রতিটি কারাগারের মনিটর অকেজো হয়ে পড়ল তা নিয়ে খোদ কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কারা অধিদফতর সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
গতকাল কাশিমপুরের চারটি কারাগারের মধ্যে একটি কারাগার-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশের শর্তে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিটি কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে দু’টি করে মনিটর স্থাপন করা হয়েছিল। শুরুতে এসব মনিটরে ভেসে ওঠা আটক বন্দীদের নাম-ঠিকানা দেখে বাইরে অপেক্ষারত তাদের স্বজনরা জানতে পারতেন, তাদের বন্দীর সর্বশেষ অবস্থানটা কোথায় আছে। একইভাবে বন্দীর জামিন হওয়ার পর তারা কারাগারের কোথায় অবস্থান করছেন এবং কবে নাগাদ কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন; সেটিও ওই মনিটেিরর স্ক্রিন দেখেই আগেভাগে স্বজনরা জানতে পারতেন। তিনি বলেন, মূলত বন্দীর কারাগার আগমন এবং মুক্তির সময় স্বজনরা দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হন। দালালচক্রের প্রতারণা ঠেকানোর লক্ষ্যই কারা কর্তৃপক্ষ এসব মনিটর স্থাপন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু বছর না পেরোতেই দেশের ৬৮ কারাগারে স্থাপিত সব মনিটর একে একে সবই অকেজো হয়ে পড়ে। এখন এর এসব মনিটরের কোনো অস্তিত্ব নেই।
গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাথে এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে নিজের পরিচয় না জানিয়ে বলেন , আমার জানা মতে এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন ওই সময়ের এআইজি ডেভেলপমেন্টের দায়িত্বে যিনি ছিলেন। ওই কর্মকর্তা পরবর্তীতে ঝালকাঠি জেলা কারাগারের জেল সুপার পদে দায়িত্বে ছিলেন এবং ওই কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে দু’টি মনিটর ডিসপ্লে লাগিয়েছিলেন বলে জানি।
গতকাল কারা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার জানা মতে ঢাকাসহ দেশের ৬৮ কারাগারের প্রতিটিতে মনিটর লাগানো হয়েছিল। এর মধ্যে একটি কারাগারের গেটের বাইরে পিসি কাউন্টারের সামনে স্থাপন করা হয়েছিল। আরেকটি কারাগারের ভেতরে কেইস টেবিলের সামনে স্থাপন করা হয়েছিল। এখন ও সবের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, এসব ডিসপ্লের সুবিধার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ধরেন একজন বন্দীর আজ জামিন হয়েছে। ওই বন্দীর নাম-ঠিকানা, মামলা নম্বরসহ বিস্তারিত ওই মনিটর ডিসপ্লেতে ভেসে উঠবে। একইসাথে ভেতরে স্থাপন করা মনিটরের ডিসপ্লেতেও বন্দীর স্বজনরা একইভাবে এই তথ্যগুলো দেখতে পাবেন। মোটকথা বন্দী ও বন্দীর স্বজনদের সার্বিক সুবিধার জন্যই এসব মনিটরের কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এগুলো স্থাপন করতে কারা অধিদফতর থেকে যে বাস্তবায়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল তাতে সরকারের কোষাগার থেকে কমপক্ষে ৪০-৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। অথচ এখন এ সবের কোনো কার্যক্রমই আর চোখে পড়ছে না। সরকারের পুরো টাকাই জলে গেছে। এখন প্রতিটি কারাগারে আগের মতো আদালত থেকে জামিনের আদেশ আসছে, জমা হচ্ছে। কিন্তু বাইরে বন্দীর স্বজনরা অপেক্ষায় থাকলেও কবে তার প্রিয় মানুষটি কারাগার থেকে বের হবেন তা আর জানতে পারছেন না।
গতকাল সোমবার রাতে কারা অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো: জান্নাত-উল ফরহাদের সাথে এসব বিষয়ের সর্বশেষ অবস্থা জানতে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি টেলিফোন রিসিভ করেননি। যার কারণে তার বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি।
কারাগার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে কারাগারের ভেতরে বাইরে উন্নয়নের নামে নানা ধরনের প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছিল। এসব মনিটর স্থাপনের নামে যারা অনিয়মের সাথে সম্পৃক্তরা তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। একই সাথে কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে স্থাপিত মনিটরগুলো আবারো সচল করা উচিত। তাদের মতে, কারা অধিদফতরসহ দেশের বেশিরভাগ কারাগারে এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা বহাল তবিয়তে আছেন এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা নানা কৌশলে বেকায়দায় ফেলতে প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন।