লবণ নীতিমালা ২০২২ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণ শিল্প মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নীতিমালার বাস্তবায়নে গাফিলতির কারণে মাঠে উৎপাদিত লবণের দরপতনে উপকূলীয় হাজারো চাষি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাই নীতিমালার মূল ধারাগুলো বাস্তবায়নে জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
গত মৌসুমে (২০২৪-২৫) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, কিন্তু উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২২ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ টন। ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় তিন লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৯ মেট্রিক টন। অথচ ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও লবণের দাম বাড়ায়নি, বরং পাইকারি বাজারের দরপতনে চাষিরা প্রতি মণে গড়ে ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছেন।
লবণ মিল মালিক সমিতির নেতারা অভিযোগ করেছেন, নীতিমালার অপূর্ণ বাস্তবায়ন ও ‘মিস ডিকলারেশন’-এর মাধ্যমে অতিরিক্ত সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি হওয়ায় স্থানীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় লাখ লাখ টন সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে, ফলে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও দেশে বিপুল পরিমাণ লবণ মজুদ রয়েছে, যা বাজারে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করছে। নেতাদের দাবি, শিল্পে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত সোডিয়াম সালফেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইড যেন তরল বা রঙিন ফরমেটে আমদানি বাধ্যতামূলক করা হয়, যাতে তা ভোজ্যলবণ হিসেবে বাজারজাত করা না যায়।
চলতি ২০২৫-২৬ মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নভেম্বরেই মাঠে লবণ উৎপাদন শুরু হবে এবং আগামী মে মাস পর্যন্ত তা চলবে।
বর্তমানে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়া ও কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৬৩ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজারেরও বেশি চাষি লবণ উৎপাদনে যুক্ত রয়েছেন।
দেশের শিল্প কারখানাগুলোর বার্ষিক সোডিয়াম সালফেটের চাহিদা ৫৬ লাখ টন, যা দেশে উৎপাদিত হয় না। এ ছাড়া সোডিয়াম ক্লোরাইড থেকেও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কেমিক্যাল উৎপাদন হয়। এই ঘাটতি পূরণে আমদানির সুযোগ দিলেও ব্যবসায়ীরা সেটিকে অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে স্থানীয় লবণচাষিরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না।
জাতীয় লবণ নীতিমালা ২০২২-এ বলা হয়েছে
১. নতুন নতুন এলাকা চিহ্নিত করে লবণ চাষ সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. প্রকৃত লবণ চাষিদের কাছে জমি বরাদ্দ দিতে হবে, যাতে উৎপাদন খরচ কমে। ৩. আমদানিকৃত লবণের শুল্কহার পুনর্বিন্যাস করে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হওয়ায় উপকূলের হাজার হাজার একর জমি প্রভাবশালীদের হাতে চলে যাচ্ছে। তারা প্রতি ৪০ শতক জমি বছরে ৭০-৮০ হাজার টাকায় নিচ্ছে, ফলে বর্গাচাষিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের চাষি মো: বেলাল ও কক্সবাজারের লেমশিখালির গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গত মৌসুমে লবণ বিক্রি করে লোকসান গুনেছি। সরকার যদি পাইকারি মূল্য নির্ধারণ ও জমির লাগিয়ত নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে লবণ চাষ বন্ধ করতে বাধ্য হব।’
চাষিদের দাবি-মাঠের লবণের পাইকারি মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা, জমির লাগিয়ত বা বর্গামূল্যে সহনীয় মানদণ্ড ঠিক করা, সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান এবং উচ্চ সুদের দাদন প্রথা বন্ধ করা জরুরি। এ ছাড়া সরকারি খাস ও বন বিভাগের দখলকৃত জমি লবণচাষিদের মধ্যে বিতরণ, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রোধ এবং বিদ্যুৎসহ সেচ সুবিধা বাড়ানো গেলে উৎপাদন খরচ কমবে বলে তারা মনে করেন।
লবণচাষিদের সতর্কবার্তা-যদি মাঠের লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আগামী কয়েক মৌসুমেই উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো চাষি লবণ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর সেটাই হবে দেশের লবণ শিল্পের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
 


