ক্ষমতার পালাবদলের পর নবজাগরণ ঘটেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। অনিয়ম দুর্নীতি রোধের পাশাপাশি দূর হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনাও। অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পদক্ষেপ। আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করতে নেয়া হয়েছে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। পাশাপাশি বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলের শ্বেতপত্র প্রকাশেরও কাজ চলছে জোরেশোরে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন হলো বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেটি ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার করে এবং সে সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করে।
অথচ বিগত আওয়ামী শাসনামলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘরে পরিণত করা হয়েছিল। শামীম মোহাম্মদ আফজল মহাপরিচালক হওয়ার পর পুরোটাই ধসে পড়ে ধর্মভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা। ইমামদের সম্মেলনে অশ্লীল নৃত্যের মতো কর্মকাণ্ডও প্রদর্শন করান তিনি। তার দীর্ঘ ১০ বছরের দায়িত্ব পালনকালে নিয়োগ কর্মকাণ্ড ছিল পুরোটাই দলীয়, আত্তীকরণ ও ঘুষের মাধ্যমে। এমন কোনো অনিয়ম ছিল না তার আমলে হয়নি। বই প্রকাশের নামে লুটে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এরপর বিগত আমলে যারাই ওই প্রতিষ্ঠানে গেছেন তারাই নিকৃষ্ট দলীয়করণ ও লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সর্বশেষ ইসলামিক এ প্রতিষ্ঠানের আগারগাঁও প্রধান কার্যালয়ের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে ক্রমেই খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায় স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানটি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রথমে সাইফুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয় সাময়িকভাবে। এরপর গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সরকার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আ: ছালাম খানকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এক ধরনের নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি হওয়া নানা জটিলতা, মামলা-মোকদ্দমা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা দূর করতে উদ্যোগ নেন তিনি। একইসাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ, পদোন্নতি জটিলতা, বকেয়া বেতন-ভাতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ শোনা, তাদের সাথে সরাসরি বৈঠক করা এবং আইনি জটিলতা নিরসনের ফলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে গতি ফিরে আসে।
তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ : দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি সিলেকশন কমিটি-৪ এর সভাপতি হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি সম্পন্ন করেন এবং শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। বহু দিনের জটিলতায় আটকে থাকা উপপরিচালক ও প্রোগ্রাম অফিসারদের সিনিয়রিটি সমস্যা সমাধান করেন। বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কার্যকর করে প্রশাসনিক স্থবিরতা ভাঙেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ নিরসনের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বসে তাদের ক্ষোভ নিরসন করেছেন সে কারণে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা। সাতজন উপপরিচালকের ভূতাপেক্ষ সিনিয়রিটি সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা হয়েছে। যেসব প্রোগ্রাম অফিসার মামলা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পদোন্নতি বন্ধ করে রেখেছিলেন তাদের সাথে আলোচনা করে ক্ষোভ নিরসন করেছেন এবং তাদের আবেদন মঞ্জুর করে দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সমাধান করেছেন। বিগত সরকারের আমলের বৈষম্যের শিকার তিনজন পরিচালকের পদোন্নতি কার্যকর করে এবং পাঁচজন সহকারী পরিচালকের পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে তাদের বেদনা দূর করেছেন। ৭০-৭৫ জন কর্মকর্তার সিলেকশন গ্রেড সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হয়েছে। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্যার সমাধান করেছেন। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইমামদের নিয়ে ইমাম সম্মেলনের আয়োজন তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ ও আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ ছিল প্রায় ৭৭ হাজার ইমাম ও প্রকল্পভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বকেয়া সম্মানী ও বেতন-ভাতা পরিশোধ। প্রকল্পে অর্থের সঙ্কট থাকলেও অন্য প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা এবং প্রায় ৭৭ হাজার ইমামের চার মাসের সম্মানী এবং দু’টি ঈদ বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে। জমিয়াতুল ফালা মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন এবং কর্মচারীদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে প্রায় ১২ বছর ধরে আটকে ছিল, তাদের চাকরি রাজস্বভুক্তির আদেশ দিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করেছেন এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন মহাপরিচালক।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা : বিগত সরকারের আমলে নিয়োগবাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এ অনিয়ম তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতিকে প্রধান করে শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে শ্বেতপত্র প্রকাশের কাজ এগিয়ে চলছে। গবেষণা, অনুবাদ, ইসলামী বিশ্বকোষ ও প্রকাশনাকার্যক্রমকে নতুন গতিতে এগিয়ে নেয়া তার আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল, যেটি তিনি দৃঢ়তার সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : মহাপরিচালক আব্দুস সালাম খান ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। নিজস্ব জমিতে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে আয় বাড়ানো এবং সরকারি অর্থের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি। একইসাথে জাতীয় ফতোয়া বোর্ড গঠন ও চট্টগ্রামে মিশনশাখা প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলছে।
আশার আলো : ধর্ম উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড অব গভর্নর্সের সমন্বয়ে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হওয়ায় ইফার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে নিয়োগ পদোন্নতির জন্য গঠিত সিলেকশন কমিটি নিয়ে এখনো তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ কমিটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অব গভর্নর্স করার কথা থাকলেও ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক একটি আমলাতান্ত্রিক কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের কোনো পদোন্নতি অথবা নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি। কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার দাবি ক্রমশই বাড়ছে। শূন্যপদ পূরণ থাকলে স্বাভাবিক কার্যক্রমের গতি আরো সঞ্চারিত হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।