কাঁচামাল আমদানিতে রফতানি মূল্য ঘোষণা বাধ্যতামূলক করেছে বিজিএমইএ

শাহ আলম নূর
Printed Edition

তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রফতানি মূল্য ঘোষণা বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। দেশের পোশাক শিল্পের সর্বোচ্চ সংগঠন নতুন এই বিধান চালু করেছে। সংগঠনের আওতায় সদস্য কারখানাগুলোকে আমদানি করা কাঁচামালের ইউনিট মূল্য এবং রফতানির জন্য উৎপাদিত তৈরী পোশাকের ইউনিট মূল্য দিতে হবে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য। এতে শিল্পে স্বচ্ছতা ও সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সম্প্রতি জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বিজিএমইএ নতুন এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এমন ঘোষণা দেয়ার পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে ইউডি সার্টিফিকেট পেতে সদস্য কারখানাগুলোকে রফতানি মূল্যের তথ্য জমা দিতে হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানিযোগ্য স্থানীয় পোশাকপণ্যের প্রতিযোগিতা ধরে রাখা এবং বিদেশী ক্রেতাদের আস্থা বজায় রাখতে আমদানি করা কাঁচামালের ইউনিট মূল্য এবং বিজিএমইএ সদস্য কারখানায় উৎপাদিত সংশ্লিষ্ট রফতানিযোগ্য পোশাকের ইউনিট মূল্য সঠিকভাবে ঘোষণা করা অত্যাবশ্যক।

ইউনিট মূল্য না থাকার কারণে শিল্পে স্বচ্ছতা ও সঠিক ভ্যালু অ্যাডিশন নিয়ে বৈশ্বিক ক্রেতা এবং স্থানীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), প্রশ্ন তুলেছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইউডি সার্টিফিকেটের জন্য আবেদনকালে নির্দিষ্ট ঘরে ইউনিট মূল্য উল্লেখের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউডি সার্টিফিকেট একটি গুরুত্বপূর্ণ শুল্ক নথি, যা শুল্কমুক্ত আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে রফতানিমুখী পোশাক উৎপাদনের অনুমোদন দেয়। এটি কাস্টমস ছাড়পত্র, রফতানি কার্যক্রম, বাণিজ্য সুবিধা ও নগদ প্রণোদনার জন্য আবশ্যক।

বিজিএমইএ ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) উভয়েই সদস্যদের ইউডি সার্টিফিকেট দেয় প্রতিটি ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে, যেখানে রফতানিকারক, আমদানিকারক ও কাঁচামালের তথ্য উল্লেখ থাকে। বিজিএমইএর তথ্যে দেখা যায়, প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ সদস্য কারখানা প্রতিটি ওয়ার্ক অর্ডারের জন্য ইউডি সার্টিফিকেট নিয়ে থাকে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথমবারের মতো ইউডি সার্ভিসে গার্মেন্টের ইউনিট মূল্য সংগ্রহ করা হবে। তিনি বলেন, এমন উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো খাতটিতে সঠিকভাবে রিটেনশন বা ভ্যালু অ্যাডিশনের মাত্রা বোঝা। বিজিএমইএ নিয়মিতভাবে এ তথ্য সংগ্রহ করবে এবং মাসিক প্রতিবেদন তৈরি করবে বলে তিনি জানান।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিশ্ববাজারে রফতানির পর কতটা ভ্যালু অ্যাডিশন হয়, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। একবার এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেলে তারা বিজিএমইএ সদস্যদের পরামর্শ দিতে পারবেন কোন ধরনের পণ্য উৎপাদন করলে বেশি মূল্য সংযোজন হবে বা উচ্চমূল্য পাওয়া যাবে। তখন সদস্যদের ভলিউমভিত্তিক উৎপাদনের বদলে ভ্যালু অ্যাডিশনে মনোযোগ দিতে সুপারিশ করা হবে।

এ দিকে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে ভ্যালু অ্যাডিশন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওঠানামা করছে এবং এখনো মহামারী-পূর্ব পর্যায়ে ফেরেনি। কারণ কাঁচামাল আমদানির বাড়তি খরচ রফতানি সুফলকে খেয়ে নিচ্ছে। রফতানিকারকরা মূলত সুতা ও কাপড়সহ কাঁচামাল আমদানির ঊর্ধ্বগতিকে দায়ী করছেন, অন্য দিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পোশাকের দামও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত স্থানীয় পোশাকের ভ্যালু অ্যাডিশন প্রায় স্থির ছিল, ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশের মধ্যে। তবে ডেটা বিশ্লেষণে ওঠানামার চিত্রে দেখা যায় ২০২০ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৫৬.৪৯ শতাংশে, ২০২১-এ বেড়ে ৫৯.১৩ শতাংশে ওঠে। আবার ২০২২-এ নেমে যায় ৫৪.৩৮ শতাংশে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ তৈরী পোশাক রফতানি করে ৩৯.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে যার মধ্যে নিটওয়্যার থেকে ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন থেকে ১৮.১৮ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৬.১২ বিলিয়ন ডলার। এমন পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরে তৈরী পোশাক খাতের নিট রফতানি আয় দাঁড়ায় ২৩.২১ বিলিয়ন ডলার, যা ৫৯.০১ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশন নির্দেশ করে। এটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মহামারী-পূর্ব ৬৪.৩২ শতাংশের চেয়ে কম।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ওভেন পোশাকের জন্য বাংলাদেশ মূলত আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে নিটওয়্যারের বেশির ভাগ কাঁচামাল স্থানীয় বাজার থেকে আসে। তবে গ্যাস সঙ্কট ও স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহারে নগদ প্রণোদনা কমে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে সুতা ও কাপড় আমদানি বেড়েছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট ফ্যাব্রিক আমদানি ৩২.১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৫১ মিলিয়ন টনে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ০.৩৮ মিলিয়ন টন। একই সময়ে ওভেন ফ্যাব্রিক আমদানি হয়েছে ০.৬২ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের (০.৫৪ মিলিয়ন টন) তুলনায় ১৬.১২ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে সুতা আমদানি বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১.২৪ মিলিয়ন টনে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১.১ মিলিয়ন টন ১৩.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি। বিটিএমএ তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮.৩৫ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৭.৭৫ মিলিয়ন বেল।