ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সুদ-চাপ বাড়ছে

২০১৬-২০২৫ সময়ে বৈদেশিক ঋণ ড্রয়িং ও ডেট সার্ভিস বিশ্লেষণ : চীন-ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

গত এক দশকে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ঋণ গ্রহণের তুলনায় ঋণ পরিশোধে সুদ ও সার্ভিস চার্জের অংশ দ্রুত বাড়ছে, যা বিনিয়োগ ব্যয় ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় নতুন চাপ তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইডি ব্যবস্থাপনা সেল-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কাঠামোতে সুদের অংশ ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ড্রয়িং বনাম ডেট সার্ভিস : ধারা কোথায় বদলেছে : ২০১৬ সালে ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ ড্রয়িং ছিল ৫৮১.৯ মিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট ডেট সার্ভিস ছিল ৯৭৩.৭ মিলিয়ন ডলার। সে সময় সুদ ও কমিশনের চাপ তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে চিত্র নাটকীয়ভাবে বদলায়- মূল ঋণ পরিশোধ হয়- ৩,১১৯.৭ মিলিয়ন ডলার আর সুদ দিতে হয়- ৩,৪২৭.৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সুদের পরিমাণ মূল ঋণের কিস্তির চেয়েও বেশি হয়ে যায়, যা ব্যক্তিখাতের ঋণব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

কোভিড-পরবর্তী সময়ে সুদের অংশ স্থায়ীভাবে উঁচু : ২০২০-২০২১ সময়ে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ঋণ ড্রয়িং বাড়লেও সুদের চাপ কমেনি। ২০২১ সালে মোট ডেট সার্ভিস দাঁড়ায় ২.১৮ বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই ছিল সুদ। ২০২২ সালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়- সুদ দাঁড়ায়- ২.৫৬ বিলিয়ন ডলার আর মূল পরিশোধের অঙ্ক হয় ২.৮২ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডলারের শক্তিশালী অবস্থান ব্যক্তিখাতের ঋণ ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২৩-২০২৪ : কমিশন ও চার্জে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি : ২০২৩ সালে সুদের পাশাপাশি কমিশন ও অন্যান্য চার্জ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়- কমিশন দাঁড়ায় : ৪১১ মিলিয়ন ডলার আর মোট ঋণ সেবা দাঁড়ায় ২.১৪ বিলিয়ন ডলার।

২০২৪ সালে এ প্রবণতা আরো স্পষ্ট হয়। এ সময়ে কমিশন দাঁড়ায়-৫৩৪ মিলিয়ন ডলার আর মোট ঋণ সুদ দাঁড়ায় ১.৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, শুধু সুদ নয়- ঋণের আনুষঙ্গিক খরচও ব্যক্তিখাতের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৫ : ড্রয়িং কমলেও পরিশোধের চাপ অব্যাহত : ২০২৫ সালে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ ড্রয়িং নেমে এসেছে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে, কিন্তু একই সময়ে- সুদ দিতে হয় ৮৭০ মিলিয়ন ডলার আর কমিশন দিতে হয় ৩৫২ মিলিয়ন ডলার। এতে বোঝা যাচ্ছে, নতুন ঋণ গ্রহণ কমলেও পুরনো ঋণের বোঝা এখনো অর্থনীতিকে চেপে ধরছে।

বিশেষ করে এপ্রিল-জুন ২০২৫ (সংশোধিত) প্রান্তিকে মাত্র ২৯৩ মিলিয়ন ডলার ড্রয়িং হলেও ডেট সার্ভিস ছিল ৫০১ মিলিয়ন ডলার- যা ঋণচক্রের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান নির্দেশ করে।

ত্রৈমাসিক চিত্র : নগদ প্রবাহে চাপ : ত্রৈমাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ড্রয়িং তুলনামূলক বেশি, কিন্তু বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ডেট সার্ভিসই প্রাধান্য পাচ্ছে। এর অর্থ, ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ এখন নতুন বিনিয়োগের চেয়ে পুরনো দায় পরিশোধে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

নীতিগত ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য : বিশ্লেষকদের মতে, এ ডেটা তিনটি বড় ঝুঁঁকির কথা বলছে- প্রথমত, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ সক্ষমতা সঙ্কুচিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত, ডলার আয়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধ ব্যয় দ্রুত বাড়ছে, তৃতীয়ত, ব্যাংকিং ও রফতানি খাতে ক্যাশ-ফ্লো চাপ বাড়ছে।

এ অবস্থায় ঋণ পুনঃতফসিল, দীর্ঘমেয়াদি পুনঃঅর্থায়ন এবং বৈদেশিক ঋণ অনুমোদনে কঠোর স্ক্রিনিং ছাড়া পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।

২০১৬-২০২৫ পর্যন্ত ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ ডেটা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে-বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর এখন ঋণ গ্রহণের চেয়ে ঋণ পরিশোধে বেশি ব্যস্ত। সুদ ও কমিশন ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে এটি শুধু ব্যক্তিখাত নয়- সামগ্রিক বৈদেশিক মুদ্রা ভারসাম্যের জন্যও বড় ঝুঁঁকিতে পরিণত হবে।

ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণে চীন-ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য : সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত দেশভিত্তিক ব্যক্তিখাত বৈদেশিক ঋণের প্রবণতা বিশ্লেষণে চীন-ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য দেখা যায় বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণে দেশভিত্তিক কাঠামোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে ব্যক্তিখাতের মোট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে চীন, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র- এ চার উৎস মিলেই ঋণের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।

মোট চিত্র : ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী : ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ- ডিসেম্বর ২০২৪ : ৯.২৯ বিলিয়ন ডলার; মার্চ ২০২৫ : ৯.৭৫ বিলিয়ন ডলার; জুন ২০২৫ (সংশোধিত) : ৯.৭৭ বিলিয়ন ডলার আর সেপ্টেম্বর ২০২৫ : ৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৯ মাসে প্রায় ৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি, যা নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পুরনো ঋণ পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।

চীন : শীর্ষ ঋণদাতা দেশ : ব্যক্তিখাতে বৈদেশিক ঋণে চীন এখনো শীর্ষ অবস্থানে- ডিসেম্বর ২০২৪ : ৩.৩১ বিলিয়ন ডলার আর সেপ্টেম্বর ২০২৫ : ৩.৪২ বিলিয়ন ডলার। মোট ব্যক্তিখাত ঋণের প্রায় ৩৪ শতাংশই চীনের উৎস থেকে। শিল্প, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সংযুক্ত প্রকল্পে চীনা অর্থায়নের উপস্থিতি এ আধিপত্যের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইউরোপীয় করিডোর : নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যের বড় অংশ : ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা- নেদারল্যান্ডস-এর ২০২৪ সালে ছিল ৯৯০ মিলিয়ন ডলার, যা ৯ মাসে বড় উল্লম্ফন এ হয়েছে- ১.৩৯ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য ২০২৪ সালে ১.১৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৫ এর ৯ মাসে ১.০৮ বিলিয়ন ডলারে নামে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক হোল্ডিং ও ফাইন্যান্সিং কাঠামো ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ায় এ বৃদ্ধি ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও হংকং : বাণিজ্যিক অর্থায়নের কেন্দ্র : যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের ৭৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে পরের ৯ মাসে হয় ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার। হংকং একই সময়ে ৫৭৮ মিলিয়ন ডলার থেকে হয় ৬১৬ মিলিয়ন ডলার।

এ দুই উৎস মূলত বাণিজ্যিক ঋণ, করপোরেট ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং চ্যানেলের সাথে যুক্ত।

জাপান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা : স্থিতিশীল প্রবাহ : জাপান ২০২৪-এর প্রায় ৩০১ মিলিয়ন ডলার, সামান্য ঊর্ধ্বমুখী হয় পরের ৯ মাসে। আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ ৯ মাসে প্রায় ৬৬১ মিলিয়ন ডলারে অপরিবর্তিত থাকে। এগুলো তুলনামূলকভাবে কম সুদ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে বিবেচিত।

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব : ১৪৭-১৪৩ মিলিয়ন ডলার; সিঙ্গাপুর : প্রায় ৫৮৯ মিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল; সংযুক্ত আরব আমিরাত : ৯.৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৮.৯ মিলিয়ন ডলার। ভারত : ৩১ মিলিয়ন ডলারে অপরিবর্তিত থাকে। এ দেশগুলোর ক্ষেত্রে ঋণ মূলত ট্রেড ফাইন্যান্স ও করপোরেট গ্রুপভিত্তিক।

ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে কিছু দেশে। এর মধ্যে সুইডেন ২ মিলিয়ন থেকে ২১.৮ মিলিয়ন ডলার; অস্ট্রিয়া : ৩১.৬-৫২.৫ মিলিয়ন ডলার হয়, যা নির্দিষ্ট করপোরেট ডিল বা পুনঃঅর্থায়নের ফল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নীতিগত ও ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য : এ দেশভিত্তিক চিত্র থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে- ১. ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ ক্রমেই চীন ও পশ্চিমা আর্থিক কেন্দ্রনির্ভর, ২. ইউরোপীয় ফাইন্যান্সিং হাবগুলোর ভূমিকা বাড়ছে, ৩. একক বা সীমিত উৎসে অতিনির্ভরতা ভবিষ্যতে ঝুঁঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে বৈশ্বিক সুদের হার বা ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনে এ ঋণ প্রবাহ দ্রুত চাপের মুখে পড়তে পারে।

সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের বৈদেশিক ঋণ দেশভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে- ঋণ এখন আর কেবল অর্থনৈতিক নয়, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। চীন ও পশ্চিমা অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর প্রাধান্য বজায় থাকলেও ঋণের বৈচিত্র্য ও ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতে ব্যক্তিখাতের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।