অটোমেশন পদ্ধতি বাতিলের দাবি : সিট খালি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে

হামিম উল কবির
Printed Edition

অটোমেশনের কারণে সিট খালি থাকছে দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে। সে কারণে এ পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এটি খুবই জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে বেসরকারি মেডিক্যালে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত আর ভর্তি হন না। শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে এই দুশ্চিন্তায় অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকার পরও তারা অন্যত্র ভর্তি হয়। ফলে সিট খালি থাকে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে।

চলতি ২০২৪-২৫ শিক্ষা বর্ষে সব মিলিয়ে ৪৬৭টি আসন ফাঁকা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। শিক্ষার্থী না পেয়ে অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে লোকসান গুনতে গুনতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। তারা বলছে, অটোমেশনের কারণে বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হতে চার থেকে ছয় মাস লেগে যাচ্ছে। ২০২২-২৩ শিক্ষা বর্ষে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করলেও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি।

বেসরকারি মেডিক্যালে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব অর্থায়নে লেখাপড়া করেন, কিন্তু সেই শিক্ষার্থীদেরই পছন্দের মূল্যায়ন হয় না। এ কারণেও বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শুধু দেশীয় শিক্ষার্থী নন, বিদেশী শিক্ষার্থীরাও অটোমেশন জটিলতায় বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকদের দাবি, অটোমেশনের নামে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে।

অন্য দিকে অভিভাবকরা বলছেন, অর্থ খরচ করেন তারা, পছন্দ ঠিক করে দেয় সরকার- এটি হতে পারে না। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, এসব ছাড়াও বেসকারি মেডিক্যাল কলেজ রিকগনিশন কমিটি (বিএমএন্ডডিসি, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়) পৃথকভাবে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনের নামে ঝামেলা করে। তাদেরকে উৎকোচ না দিলে ঝামেলা মেটানো যায় না, শেষ পর্যন্ত উৎকোচ দিতেই হয়।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো আরো অভিযোগ করছে, অটোমেশনের কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৈরি ‘ভর্তি হতে ইচ্ছুক’ তালিকায় শিক্ষার্থীদের পছন্দকে গুরুত্ব না দেয়ায় অনেকে শেষ পর্যন্ত এমবিবিএস কোর্স শেষ করতে পারেন না, ঝরে পড়েন। যেমন রাজধানীতে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা রাজধানীতেই থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু যারা ঢাকার বাইরে গ্রামের দিকে চলে যেতে বাধ্য হন তারা অনেক সময় ঝরে পড়েন। তা ছাড়া নিজেদের পছন্দ উপেক্ষিত হয় বলেও শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারেন না বলে ঝরে পড়েন অনেকে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, অটোমেশনে ভর্তি হওয়ার পাস নম্বর ৪০। কিন্তু এর আগে যখন অটোমেশন ছিল না তখন বেসরকারি মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ মেধা তালিকা মানতো না। তাদের পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করতেন। তখন মেধার মূল্যায়ন না হয়ে অর্থের মূল্যায়ন হতো বলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। অটোমেশন চালুই করা হয় মেধার মূল্যায়ন যেন হয়।

অটোমেশনের কারণে বেসরকারি মেডিক্যালে সিট খালি থাকছে এই অভিযোগের উত্তরে অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যেসব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে সিট খালি থাকে সেখানে শিক্ষার্থীরা হয় না। অটোমেশন বাদ দিয়ে ভর্তি উন্মুক্ত করে দিলে বেসরকারি মেডিক্যালে আরো সিট খালি থাকবে ভবিষ্যতে। শিক্ষার্থীদের শুধু চয়েস থাকলেই হবে না তাদের মেধাও থাকতে হবে। আমরা মেধা ও চয়েসের প্লেসমেন্ট করে দিয়েছি।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, অটোমেশনের নামে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বাধা দেয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, মালিকপক্ষ এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এই পদ্ধতি যেন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে ধ্বংস না করে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে।

অপরদিকে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, আসন শূন্য থাকায় ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ শিক্ষা বর্ষে অটোমেশনে ৪ থেকে ৬ বার মেধা তালিকা পাঠানো হলেও অনেকেই তাদের পছন্দের কলেজ না পেয়ে ভর্তি হয়নি। এ ছাড়া প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মেডিক্যাল না পড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এমনকি বিনা খরচে দরিদ্র ও মেধাবী কোটায় থাকার পরও পছন্দমতো কলেজ না পেয়ে লেখাপড়া শেষ করেননি অনেকে। অটোমেশন চালু হওয়ায় ক্লাসও বিলম্বে শুরু করতে হয়। কয়েকবার মেধা তালিকা প্রকাশের পরও আসন খালিই থাকছে। আবার এই বার বার মেধা তালিকা প্রকাশের কারণে ভর্তি হওয়া অনেক শিক্ষার্থী অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। বিদেশী শিক্ষার্থীরাও আগের মতো ভর্তি হচ্ছে না বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। ২০২১-২২, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিদেশী শিক্ষার্থীদের আসন ৪৫ শতাংশ পূরণ হয়। পরের দুই বছর ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষেও বিদেশী শিক্ষার্থী কম ছিল। ফলে বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষাখাতে সরকার কাক্সিক্ষত বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না।