ক্যাপাসিটি চার্জের ভারে দিশেহারা বিদ্যুৎ খাত

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কেন্দ্রে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা, পতিত সরকারের আমলে দলীয় লোকদের উচ্চমূল্যে বিনা টেন্ডারে অব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন, ডলার সঙ্কট এবং ব্যয়বহুল জ্বালানি আমদানির চাপে এখন উল্টো দিশেহারা পুরো বিদ্যুৎ খাত। আর এই অচলাবস্থার প্রধান বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ, যা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়াচ্ছে।

অতিরিক্ত সক্ষমতার পেছনে ‘লুকানো ব্যয়’ : গত এক দশকে সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) এবং ভাড়া বা কুইকরেন্টাল প্ল্যান্টে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা দিয়েছে। এর অধীনে কেন্দ্রগুলো চালু থাকুক বা না থাকুক, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। উদ্দেশ্য ছিল বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি হ্রাস, কিন্তু চাহিদা বাস্তবসম্মতভাবে না বাড়ায় আজ তা উল্টো চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, দেশের মোট স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি ওঠে না। অর্থাৎ ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকে, অথচ এর পেছনে প্রতি বছর ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

জ্বালানি আমদানির ব্যয় ও ডলার সঙ্কট : বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ নির্ভর করে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর, এলএনজি, ডিজেল, হাই-সালফার ফার্নেস অয়েল ইত্যাদি। ডলার সঙ্কটের কারণে বহুবার জ্বালানি আমদানি বিলম্বিত হওয়ায় কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমেছে। ফলে একদিকে জ্বালানির অভাবে কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না, আবার অন্যদিকে চালাতে না পারলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ খরচের সামগ্রিক ভার আরো বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ইতোমধ্যে বিপুল অঙ্কের লোকসানে পড়েছে। সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী সরকারকে ভর্তুকি হিসাবে প্রতি বছর ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ক্যাপাসিটি চার্জ ও উচ্চমূল্যের জ্বালানির ব্যয়ে চলে যায়।

গ্রাহকের বিল বাড়ছে, চাপ বাড়ছে সরকারেরও : ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে অস্থিরতার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। কয়েক দফা ট্যারিফ সমন্বয়ের ফলে গৃহস্থ ও শিল্প, দুই খাতেই বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে। এর পেছনে মূল কারণ বিপিডিবির লোকসান কমানো এবং ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য অর্থ জোগান দেয়া। সরকার চায় ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমাতে, কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা কমানো ছাড়া ট্যারিফ সমন্বয় দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মূল সমস্যার তেমন উন্নতি হচ্ছে না।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, আইপিপি ও বিপিডিবি কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বিপিডিবির কাছে ৭০টির বেশি দেশী-বিদেশী আইপিপির বকেয়া পাওনা এখন ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদনকারীদের পাওনা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, বাকি অর্থ বিদেশী উদ্যোগে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর।

বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৫টি, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৬৩টি কেন্দ্র সরকারি মালিকানাধীন, যারা ১১ হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এটি দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৪২ শতাংশ।

এ ছাড়া যৌথ উদ্যোগের দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দুই হাজার ৪৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা মোট সক্ষমতার ৯ শতাংশ।

অসম চুক্তির দায় কার? : জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক আইপিপি চুক্তি ছিল অত্যন্ত সুবিধাজনক ও অসম; বিনিয়োগকারীদের লাভ নিশ্চিত করা হলেও গ্রাহকের পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়তি অর্থ। কিছু চুক্তিতে ‘টেক-অর-পে’ ধারার শর্ত এতটাই কঠোর যে কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও বিপিডিবিকে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করতেই হয়। আবার একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক তাড়না ও পরিকল্পনাহীনতার ফলে প্রকৃত বিদ্যুৎচাহিদার পূর্বাভাসগুলো বাস্তবানুগ ছিল না; দীর্ঘমেয়াদে চাহিদা বাড়বে ধরে নিয়ে একের পর এক কেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

সমাধান কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ কমাতে হলে ব্যবস্থা নিতে হবে তিন দিক থেকে।

চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন : মেয়াদোত্তীর্ণ আইপিপি চুক্তিগুলো নবায়নের আগে ফের আলোচনা করে শর্ত সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্য : শিল্প খাতে অবকাঠামো সমর্থন ও সঞ্চালন সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে বিদ্যুৎচাহিদা বাড়ানো যায় এবং অব্যবহৃত ক্ষমতা কমে।

নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনে জোর : গ্যাস অনুসন্ধান, কয়লানীতি নির্ধারণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ালে আমদানিনির্ভর ব্যয় কমবে।

ক্যাপাসিটি চার্জ একসময় বিনিয়োগ আকর্ষণের সফল কৌশল ছিল, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করছে। অতিরিক্ত সক্ষমতা, ডলার সঙ্কট ও জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা মিলে বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক চাপ সীমায় পৌঁছেছে। চুক্তি পুনর্বিবেচনা এবং বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা না হলে গ্রাহক ও সরকার, উভয়ের ওপরই এই ব্যয় আরো বাড়বে।