নারায়ণগঞ্জের ক্ষুদ্র রফতানিকারক আয়েশার গল্প শুধু একটি ব্যক্তির নয়; এটি প্রকাশ করছে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট ব্যবস্থার নীতিগত ও বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ। তার গুদামে সাজানো জুটভিত্তিক পণ্যগুলো (টেবিল ম্যাট, ইকো-ব্যাগ, বাঁশের ঝুঁড়ি) ইউরোপে বুটিক রিটেইল চেইনে প্রেরণের জন্য অপেক্ষা করছে। এপ্রিল ২০২৫-এ ভারতীয় ট্রানজিট সুবিধা হঠাৎ বন্ধ হওয়ার পর তার রফতানির খরচ প্রায় ৪০% বেড়ে গেছে। এই ধরনের সঙ্কট শুধু আয়েশার জন্য নয়, বরং দেশের হাজার হাজার ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীর জন্যও ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে, যারা দেশের রফতানি শিল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত।
ঢাকা ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্সের (ডায়রা) গবেষণা সহকারী এস এম আবির হোসেন ও গবেষণা ইন্টার্ন জাহিদ হোসেন লিখিত এক গবেষণা নিবন্ধে এ কথা বলা হয়। এতে বলা হয়- বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট চুক্তির পুনর্বিবেচনা ও সমানাধিকার নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ।
ট্রানজিট বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এতে বলা হয়- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ১.৯৭ বিলিয়ন, আর ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
নিবন্ধে বলা হয়- মূল ট্রানজিট সুবিধা ছিল, ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের জন্য মালামাল রফতানি করা। বাংলাদেশের আশা ছিল- তৃতীয় দেশে দ্রুত, সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পাঠানো এবং আংশিকভাবে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। কিন্তু বাস্তবতা হলো- শুধুমাত্র ট্রানজিটে ভারতই লাভবান হয়েছে। আর বাংলাদেশী রফতানিকর্তারা এখন ব্যয়বৃদ্ধি ও বিলম্ব মোকাবেলা করছেন।
ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব পড়েছে নানাভাবে। খরচ বৃদ্ধি ও বিতরণ বিলম্বে কলকাতা বা মুম্বাইয়ের দূরবর্তী বন্দর ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ায় শিপিং খরচ ৬ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়সীমা শিথিল হওয়ায় মৌসুমি অর্ডার হাতছাড়া হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট ও ঢাকা বিমানবন্দরগুলোতে অতিরিক্ত চাপ, বিশেষ চাহিদার ক্ষেত্রে চার্টার্ড ফ্লাইট ব্যবহার করতে হয়েছে।
শিল্পে এর বিস্তৃত প্রভাব আরো বেশি। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দেশের রফতানির প্রায় ৮০% দায়িত্বে আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি রফতানিকারকরা আয়ের উৎস হারাচ্ছেন, যা লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও সরবরাহকারীকে প্রভাবিত করছে।
দুই দেশের নীতিগত ও বাণিজ্যিক অসমতা বিশেষভাবে এখন দৃশ্যমান। ভারতীয় নীতি যেখানে ট্রানজিট সুবিধা হঠাৎ বন্ধ করা, দেশীয় শিল্প সুরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বাজার অগ্রাধিকার। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি : সবসময় ট্রানজিট চুক্তি মেনে চলা।
নন-ট্যারিফ বাধার ক্ষেত্রে জুট, বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্য এখন শুধুমাত্র মুম্বাইয়ের নাভা শেভা বন্দরের মাধ্যমে প্রবেশ করা যায়। ১৩টি স্থলবন্দর থেকে সাতটি পণ্যের প্রবেশ বন্ধ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ সব ধরনের সুবিধা (ডিউটি-ফ্রি, কোটা-ফ্রি) পেলেও ভারতীয় বাজারে প্রবেশ সীমাবদ্ধ।
নিবন্ধে বলা হয়-পারস্পরিক সুবিচারের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বাংলাদেশকে এখন স্পষ্ট নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে :
- ট্রানজিটকে বাণিজ্যিক সেবা হিসেবে মূল্যায়ন- কূটনৈতিক দান নয়।
- ভারতীয় মালামাল প্রবেশের সমান সুযোগ- যাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা সমান সুবিধা পায়।
- নন-ট্যারিফ বাধা হ্রাসের স্পষ্ট প্রক্রিয়া চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
- ট্রানজিট এবং বাণিজ্য কমিশন গঠন- অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, পরিবেশ ও কূটনীতিবিদ বিশ্লেষক অন্তর্ভুক্ত।
- পুনঃসংলাপ ও সমঝোতা, যা দেশের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে।
দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যার মধ্যে থাকবে-
- কম খরচে বিকল্প রুট তৈরি করা: সমুদ্রপথ, এয়ার কার্গো।
- সাপ্লাই চেইন স্থিতিশীলতা বজায় রাখা : ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ট্রানজিট ফান্ড/সাবসিডি।
- দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে চাপ তৈরি করা : বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে প্রবেশ সুবিধা নিশ্চিত করা।
দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসাবে-
- কৌশলগত বৈচিত্র্য : রফতানি নির্ভরতা ভারতের ওপর সীমিত করা।
- মূল্য সংযোজন ও উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি : স্থানীয় জুট ও বস্ত্র শিল্পকে বিশ্বমানের হিসেবে গড়ে তোলা।
- ডিপ্লোমেসি ও বাণিজ্য সংযোগ উন্নয়ন : বিমসটেক ও সাফটার মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
আয়েশার গল্পের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে ছোট ব্যবসায়ীরা দেশের রফতানি সেক্টরের ভিত্তি। ভারতীয় ট্রানজিট বন্ধ হওয়া শুধু তাদের জন্য নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও রফতানি ধারাবাহিকতার জন্য একটি হুমকি।



