আরিফ খান জয় ছিলেন খ্যাতিমান ফুটবলার, বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক। পরবর্তীতে নাম লেখান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচনে নেত্রকোনা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য (এমপি) হন এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। এমপি হওয়ার পর পরই জড়িয়ে পড়েন একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, তদবির ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে যান। গত ১০ বছরে নগদ অর্থসহ সব ধরনের সম্পদ বেড়েছে কয়েকগুণ। এর মধ্যে শুধু কাগজে কলমে বেড়েছে নগদ টাকা তিন গুণ ও ব্যাংকে জমা বেড়েছে ৯ গুণ। শূন্যের কোটায় থাকা তার স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে বহুগুণে। কাগজে-কলমে স্ত্রীকে লাখপতি দেখালেও প্রকৃতপক্ষে কোটিপতি বনে গেছেন বলে স্থানীয় ও দুদক সূত্রে জানা গেছে। আরিফ খান জয়ের অবৈধ সম্পদের খোঁজে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
শূন্য থেকে কোটিপতি : হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় আরিফ খান জয় দেখিয়েছিলেন ১২ লাখ ১৪ হাজার ২৭৮ টাকা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেখান ৩২ লাখ ৬৯ হাজার ১১ টাকা। সেবার ব্যাংকে জমা দেখিয়েছিলেন ১৭ লাখ টাকা। এবার তা বেড়ে হয়েছে দেড় কোটি টাকা, যা আগের বারের চেয়ে নয় গুণ বেশি। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ চমক দেখিয়েছেন। ২০১৪ সালের হলফনামায় শূন্য দেখালেও ২০২৪ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৯৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯০৯ টাকায়। ২০১৪ সালে স্ত্রীর নামে কোনো অর্থ সম্পদ না দেখালেও কয়েকটি ধাপে দেখানো হয়েছে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে উপহারের স্বর্ণালঙ্কার দেখানো হয় ২০ ভরি।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আলোচনায় : ফুটবল ও রাজনীতির মাঠে ২০১২ সাল থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আরিফ খান জয়। ২০১২ সালে পিস্তল নিয়ে খেলার মাঠে রেফারিদের শাসিয়ে ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েন সাবেক এই তারকা ফুটবলার। ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুব দিবস পালন অনুষ্ঠানের ব্যানারে তার নাম না রাখায় ক্ষুব্ধ হয়ে যুগ্ম সচিব মাশুক মিয়ার কক্ষ ভাঙচুর করেন জয়। ২০১৬ সালের ২ এপ্রিল আশুলিয়ায় পুলিশের এসআই মলয় কুমার সাহাকে পিটিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জয় নেত্রকোনা শহরের আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পাশে এ আর খান পাঠান সিএনজি স্টেশন উদ্বোধন করেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। আলোচনা রয়েছে, এ আর খান মুক্তিযুদ্ধের সময় নেত্রকোনা জেলা শান্তি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। এভাবেই একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকেও তিনি ছিটকে পড়েন।
জয়ের দুর্নীতির সিন্ডিকেট : ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আরিফ খান জয়। তার সহোদররা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। নেত্রকোনা বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যালয়ে জয়ের নিজস্ব প্রতিনিধি ছিল। সেখানে তার মাধ্যমে টেন্ডারের কাজ পরিচালনা করতেন আওয়ামী লীগের এই সাবেক এমপি। শুধু জয় নয়, অনিয়মের খাতায় নাম লেখান তার ভাইয়েরাও। জয় উপমন্ত্রী হওয়ার পরই ভাইদের হাতে আলাদ্বীনের চেরাগ চলে আসে! তাদের প্রত্যেকেই একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করেন বলে জানা গেছে।
জয়ের ভাইদের মধ্যে সবার বড় শামীম খান টিটু। তিনি চা বাগানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি নেত্রকোনায় চলে আসেন। জয়ের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে হাটবাজার, টেম্পোস্ট্যান্ড, রিকশাস্ট্যান্ড ও বাসস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে সব ভাইয়ের বিরুদ্ধে। ছোট ভাইয়ের মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতিও হন টিটু। নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নানা কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন টিটু। ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় নূর খান মিঠু। তিনি নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জেলায় ঠিকাদারি ও সারসহ অন্যান্য ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জায়গা-জমি দখল, টিআর-কাবিখায় অনিয়মের বহু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জয়ের আরেক ভাই হলেন সাইফ খান বিপ্লব। তিনি নেত্রকোনা জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। বারহাট্টা থানার সিরাম ইউনিয়নে অবস্থিত তাহেরা মান্নান উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন বিপ্লব। জয়ের আরেক ছোট ভাই অমিত খান শুভ্র বেশির ভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করলেও তিনি দুগিয়া মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই এলাকাবাসীর।
জয়ের সবচেয়ে ছোট ভাই মাসুদ খান জনি নেত্রকোনা জেলা যুবলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের কাছে ‘নেত্রকোনার যুবরাজ’ নামে খ্যাত ছিলেন। পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে তার দৌড়ঝাঁপ ছিল। এ ছাড়া স্থানীয় যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগে জয় ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য করার তীব্র অভিযোগও রয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাবেক এই ফুটবলার ও তার ভাইয়েরা।
জানা গেছে, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা বিতর্কের কারণে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি আরিফ খান জয়। তবে সবশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে পুনরায় এমপি হন তিনি। নেত্রকোনা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর একাধিক নেতা বলেন, জয় ও তার পাঁচ ভাই বেশ বিতর্কিত। ভাইয়েরা ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। জয় এমপি ও উপমন্ত্রী হওয়ার পর সবাই বিলাসী জীবন কাটাতেন। প্রত্যেক ভাই একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ওই নেতাদের দাবি, এলাকায় যে ক’জনের পুলিশে চাকরি হয়েছে। সবার কাছ থেকেই আরিফ খান জয় বড় অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলমান থাকায় এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল আরিফ খান জয়, তার স্ত্রী সোনিয়া আরিফ সোমা, ছেলে খান জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান ও মেয়ে উম্মে সাওদা খানের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ দিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে ১৯ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। যার ফল তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।



