চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিতে আগুন

ঘটনাটি পরিকল্পিত : সাদা দল তদন্ত কমিটি গঠন, মামলা

হারুন ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Printed Edition
আগুনে পুড়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি
আগুনে পুড়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি |নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও শান্তির পায়রা মোটিফে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার ভোররাতে চার দেয়ালের ভেতরে তৈরি করা এই মোটিফে আগুন দেয়া হয়। এসব প্রতিকৃতিতে আগুন দেয়ার ঘটনায় সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ বছরের বাংলা নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বাঁশ-বেতের কারুকাজে তৈরি করা হয়েছিল দৈত্যাকৃতির ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’, যার উচ্চতা ছিল প্রায় ২০ ফুট। এতে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার একটি মুখাবয়বের মাথার দু’পাশে ছিল শিং। প্রতিকৃতিটিতে ইতোমধ্যেই প্রলেপের কাজ শেষ হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটিই ছিল এবারের শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ।

মুখাবয়বটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিকট বেশ কিছু বেনামী চিঠিও দেয়া হয়। তাতে মুখাকৃতিটি সরিয়ে ফেলার জন্য বলা হয়। যদি না সরানো হয়, আয়োজনে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে হুমকির আভাস দেয়া চিঠিতে। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানালেও তারা গায়ে মাখেননি। এমনকি এ বিষয়ে দৈনিক নয়া দিগন্তেও নিউজ হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির প্রক্টরিয়াল টিমের একাধিক সদস্য বলেন, আমাদের রাতে ডিউটিতে ছিল মাত্র চারজন। তবে এখানে কেউ ছিল না। রাত ৮টার দিকে আমরা চলে যাই। পুলিশ গেটে দায়িত্বে ছিল।

কেন নিরাপত্তা নিয়ে জোরালো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিতে যে আগুন দেয়া ঘটেছে সেটা কাপুরুষোচিত আচরণ। সুযোগ বুঝে দুষ্কৃতিকারীরা মুখাকৃতিতে আগুন দিয়েছে। সকালেই জিডি করা হয়েছে। দুপুরে মামলা করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে মুখোশধারী একজনকে আগুন দিতে দেখা গেছে। ওই ব্যক্তির পরনে ছিল জিন্স ও কালো টিশার্ট, মুখে কালো মাস্ক। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় মোটিফটিতে আগুন দেন। তার পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। পুলিশ এ ব্যাপারে তদন্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল জানান, ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে টার্গেট করে আগুন লাগানো হয়েছে। ওই আকৃতি পুরোটাই পুড়ে গেছে। একই সাথে পায়রার অবয়বটাও পুড়ে গেছে। ভোররাত আনুমানিক ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে আগুন লাগানো হয়েছে।

এ দিকে চারুকলা অনুষদে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি পোড়ানোর ঘটনায় শোভাযাত্রা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। এমন গুঞ্জনের জবাবে সহকারী প্রক্টর মো: ইসরাফিল প্রাং বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তির জন্য আমাদের শোভাযাত্রা থেমে যাবে না, শোভাযাত্রা হবেই।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো: নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে যেটা মনে হচ্ছে এটি এক্সিডেন্টাল না, কেউ ইনটেনশনালি এটি করছে। এটুকু আমরা নিশ্চিত।

যা জানালো চারুকলা অনুষদ : ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ পুড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে চারুকলা অনুষদের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে চার পাশে অনেক ক্যামেরা আছে। আমরা ডিজিটাল রেকর্ডগুলো নিব, ফরেনসিক করব। ডিটেকশন করে ফেলব ইনশা আল্লাহ। এ পর্যায়ে বলার স্কোপ আসেনি যে, পার্টিকুলারলি কারা করছে। এটি এ মুহূর্তে বলা যাবে না। এটা ইনভেস্টিগেশনে বের হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। এখানে দুটো মোটিফ পোড়ানো হইছে। তিনি বলেন, বিগত সরকারপ্রধানের একটা পোট্রেইট করা হয়েছে। ওটা পোড়াতে গিয়ে সম্ভবতো কবুতরের আংশিক অংশ পোড়ানো হয়েছে। তাহলে ওই জিনিসটা যারা পছন্দ করে না, তারা এ কাজটি করবে। এটি একটা অনুমাননির্ভর কথা।

পূর্ণ তদন্ত শেষে বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যে আগুনটা লাগিয়েছে তাকে ডিটেক্ট করতে পারলে তার মাস্টারমাইন্ড কারা বা এটার সাথে কারা জড়িত এটার ডিটেইল আমরা পরে বলতে পারব। তিনি বলেন, আমার এখানে ১০ জনের ফোর্স থাকে। গেইটে থাকে কিছু, এখানে থাকে তিনজন। আমি ওদেরকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানতে পারব তারা কই ছিল, কী অবস্থায় ছিল বা কিভাবে আগুনটা লেগেছে। তাদের কাছ থেকে কিছুটা তথ্য পাওয়া যাবে। আর ভিডিওফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারব।

সংস্কৃতি উপদেষ্টার পোস্ট : বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছেন তিনি। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘হাসিনার দোসররা গতকাল ভোররাতে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে- সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।

এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদেরকে আইনের আওতায় আনব তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়।

কালকে রাতের ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটি চায় না। আমরা এখন আরো বেশি ডিটারমাইনড এবং আরো বেশি সংখ্যায় অংশ নিব।

গত কিছু দিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সব রকম মতো নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মতো জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরো অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠল।’

তদন্ত কমিটি গঠন : চারুকলা অনুষদে মোটিফ পোড়ানোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক বার্তায় এমনটা জানানো হয়। এতে বলা হয়, বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় প্রদর্শনের জন্য চারুকলা অনুষদ কর্তৃক নির্মিত দানবীয় ফ্যাসিস্টের প্রতীকী মোটিফ পোড়ানোর ঘটনা তদন্তের জন্য কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোসাদ্দেক হোসেন কামাল এবং সহকারী প্রক্টর ড. এ কে এম নূর আলম সিদ্দিকী। সহকারী প্রক্টর মো: ইসরাফিল প্রাং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

আগুন রহস্যজনক নয়, পরিকল্পিত - সাদা দল : ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও শান্তির পায়রা মোটিফে আগুন দেয়ার ঘটনার নিন্দা প্রতিবাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। একই সাথে অবিলম্বে অগ্নিকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায় সংগঠনটি।

গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো: মোর্শেদ হাসান খান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ড. মো: আবুল কালাম সরকার এক বিবৃতিতে এই দাবি জানান।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের স্মারক পয়লা বৈশাখ। এ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপনের আর মাত্র দুই দিন বাকি। আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপনের জন্য ফ্যাসিস্টদের প্রতিকৃতি তৈরিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ দিকে তখন শনিবার ভোররাতে চারুকলা অনুষদের চার দেয়ালের ভেতরে তৈরি করা এসব প্রতিকৃতিতে আগুন দেয়া নিছক কোনো রহস্যজনক নয়। এটি একটি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড। এ ঘটনায় ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারের দোসর কিংবা ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের হাত থাকার সম্ভাবনা বেশি।

নেতৃবৃন্দ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বেখেয়ালিপনা নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন, পয়লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা পালনের লক্ষ্যে তৈরিকৃত প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য জিনিসের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর চারুকলার শোভাযাত্রা নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা অত্যাবশ্যক ছিল। অতএব, পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি।