পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দিয়ে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্টের আশঙ্কা করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি অশান্ত করা ও দেশে-বিদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুনাম নষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের স্ত্রী ইয়েন ইয়েন-এর বিদেশী সমর্থন ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির সুপারিশ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদন সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় সংহতি প্রশ্নে যেসব বিতর্ক ও উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইয়েন ইয়েন নামটি বার বার উঠে আসছে। নারী অধিকার কর্মীর পাশাপাশি চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার রক্ষার নামে বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার, সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। তার কর্মকাণ্ড, বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা বিকৃত করে উপস্থাপন করার প্রবণতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য উদে¦গজনক বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে।
তার গত কয়েক বছরের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ছবি এবং বিস্তারিত বিবরণী পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়েন ইয়েন পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন সংগ্রহ ও অপপ্রচার চালিয়ে আসছেন। তিনি সামাজিক আন্দোলন ও নারী অধিকারের আড়ালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণকে উসকে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে জাতিগত সঙ্ঘাত ও বাঙালি-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করছেন। তার উসকানিমূলক বক্তব্য, বিতর্কিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন এবং কেএনএফ, জেএসএস, ইউপিডিএফ -এর প্রতি পক্ষপাতমূলক অবস্থান পাহাড়ে সহিংসতা উসকে দিতে পারে। এ ধরনের অস্থিরতা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েন ইয়েনের কর্মকাণ্ড এসব সম্প্রীতি নষ্ট করার পিছনে কাজ করছে। তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ও চাকমা আধিপত্যবাদকে ধারালো করার জন্য পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব প্রচার করছেন। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে এবং সামগ্রিক সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে।
ইয়েন ইয়েন বিদেশী দাতা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় কেএনএফ, জেএসএস, ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছেন। এই সমর্থনের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাস ও বিদ্রোহের পুনরুজ্জীবনের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
ইয়েন ইয়েন সম্প্রতি ফ্রান্সে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী-বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের নীতি, সামরিক কর্মকাণ্ড এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে (ফরাসি সংসদ, জাতিসঙ্ঘের ফোরাম, বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মনগড়া অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল করতে পারে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন হ্রাস পেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অস্থিরতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি সুস্পষ্ট ও গভীর হুমকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ইয়েন ইয়েন ও তার সমর্থকদের কার্যকলাপ পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ উসকে দিয়ে দেশের একাংশকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে। এই ধরনের তৎপরতা শুধু জাতীয় অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতা নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ইয়েন ইয়েন বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত কেএনএফ এবং অন্যান্য পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনের প্রতি সরাসরি সহানুভূতিশীল অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি তাদের মুক্তির দাবিতে প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় প্রচার চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেএনএফ-এর রাষ্ট্রবিদ্রোহী কার্যক্রম স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়া তার রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের পরিচায়ক, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
ইয়েন ইয়েন সংবিধানে বর্ণিত ধারা ২৩ (ক)তে উল্লেখিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা জাতিসত্তার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন, যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল এবং পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগে সরকারের সিদ্ধান্তের চরম সমালোচনা করে বিভ্রান্তি ও উসকানিমূলক তথ্য প্রচার করেন। মানবাধিকার আন্দোলনের আড়ালে তিনি সর্বদা রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরি করে ঐক্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার প্রয়াস চালান। সার্বিকভাবে, ইয়েন ইয়েনের কর্মকাণ্ড একটি সূক্ষ্ম কিন্তু সুসংগঠিত রাষ্ট্রবিরোধী নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদের পথে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, সামরিক/প্রশাসনিক/ জাতিগত মর্যাদা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে তিনটি সুপারিশ করা হয়। তাদের সুপারিশগুলো হলো, ইয়েন ইয়েন-এর বিদেশী সমর্থন ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা যেতে পারে। ইয়েন ইয়েন’কে প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য প্রচার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা, বিদেশে বাংলাদেশ ও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা এবং প্রকাশ্যে সূক্ষ্ম রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য আইনগতভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতে পারে। কোনো বিদেশী গোষ্ঠী বা মহল থেকে তিনি আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্ররোচনা দিচ্ছেন কি না তা তদন্ত করা যেতে পারে।