বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি সংবেদনশীল মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহে সামান্য স্বস্তি ফিরে এসেছে, অন্য দিকে ব্যাংকিং খাতের অস্বাস্থ্যকর ঋণ প্রবণতা, সীমিত রফতানি প্রবৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব চাপ ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (১২ অক্টোবর ’২৫) নির্বাচিত অর্থনৈতিক সূচক অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যভাগে প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব ও রিজার্ভ- এ তিন সূচকই নতুন ভারসাম্যের সন্ধানে আছে। অর্থনীতির সাম্প্রতিক চিত্রে এক দিকে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে- রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রিজার্ভে সামান্য স্থিতি, অন্য দিকে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, সীমিত রফতানি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন সময় ‘সঙ্কটের আগেই সাড়া দেয়ার’- নয়তো আর্থিক খাতের দুর্বলতা দ্রুত সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যকেও নাড়িয়ে দিতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সাময়িক স্থিতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিপিএম৬ অনুযায়ী ২৭.১ বিলিয়ন ডলার)। এটি গত বছরের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়, যদিও এটি এখনো ২০২১ সালের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রিজার্ভের তুলনায় অনেক কম।
রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রধান উৎস রেমিট্যান্স- যা ২০২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর যা আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি। নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স ১৬ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিকে অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ বলা হচ্ছে, কারণ এটি আমদানি ঘাটতি মোকাবেলায় ও চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে রিজার্ভ স্থিতি সত্ত্বেও, বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, আমদানি ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান ধারা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়সূচি ভবিষ্যতে আবারো চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
রফতানি-আমদানির ভারসাম্যহীনতা ও বাণিজ্য ঘাটতি : ২০২৫ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৭.৭২ শতাংশ বেশি। তবে একই সময়ে আমদানি বেড়ে ৬৮.৩৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। নতুন অর্থবছরেও একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বছরের প্রথম মাসে আমদানি সাড়ে ১৯ শতাংশ এবং রফতানি ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে। তবে আমদানি রফতানির ব্যবধান চলতি হিসাবে চাপ বাড়াচ্ছে।
রফতানি বৃদ্ধির মূল অবদান তৈরি পোশাক খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা এখনো বড় ঝুঁঁকি। তা ছাড়া, বৈশ্বিক মন্দা ও ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে ক্রয়চাহিদা কমে যাওয়ায় রফতানিকারকদের মুনাফার মার্জিন সঙ্কুচিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি রফতানি খাতে প্রযুক্তিনির্ভর ও মূল্যসংযোজিত পণ্য সংযোজন না করা হয়, তাহলে মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
ব্যাংকিং খাতে অস্বাস্থ্যকর ঋণের বিস্ফোরণ : সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্রটি দেখা যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। ২০২৩ সালের মার্চে মোট ঋণের ৮.৮০ শতাংশ ছিল অনাদায়ী বা খেলাপি। ২০২৫ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪.১৩ শতাংশে। একই সময়ে নেট ক্লাসিফাইড ঋণ বেড়ে ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। খেলাপি ঋণের অব্যাহত বৃদ্ধি বেশ উদ্বেগজনক। মার্চ ’২৪-এ খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ১১.১১ শতাংশ , তা জুন ’২৪ -এ ১২.৫৬, সেপ্টেম্বর ’২৪-এ ১৬.৯৩, ডিসেম্বর ’২৪-এ ২০.২০ আর মার্চ ’২৫-এ দাঁড়ায় ২৪.১৩ শতাংশে।
এ প্রবণতা কেবল ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতা নয়, বরং বৃহত্তর অর্থনীতির আর্থিক ঝুঁঁকিরও প্রতিফলন। সরকার-নির্ভর খাতে অতিরিক্ত ঋণপ্রবাহ, রাজনৈতিক প্রভাবিত ঋণ বিতরণ ও দুর্বল তদারকি ব্যবস্থাকে এর মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনকার সবচেয়ে বড় ঝুঁঁকি হলো, ব্যাংকগুলো নিজেরাই তারল্য সঙ্কটে পড়ছে, কারণ তাদের সম্পদের বড় অংশ অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়েছে।
রাজস্ব ও সঞ্চয়খাতে চাপ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় তিন লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২.২৩ শতাংশ বৃদ্ধি। অর্থাৎ, রাজস্ব সংগ্রহ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো বার্তা নয়। নতুন অর্থবছরের শুরুর মাসে অবশ্য ২৪.৩৩ শতাংশ রাজস্ব বাড়াতে সক্ষম হয়েছে এনবিআর।
অন্য দিকে, জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বড় ধস দেখা গেছে। নেট সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ৬,০৬৩ কোটি টাকা, যদিও মোট বকেয়া এখনো তিন লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এটি ইঙ্গিত করে যে জনগণ সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ কমিয়ে ব্যাংকিং খাতে বা নগদে অর্থ রাখছে।
মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতি : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত হলেও উদ্বেগ আছে। ভোক্তা মূল্যস্ফীতির (সিপিআই) ভিত্তিতে দেখা যায়, বারো মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৯.৯৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ কমে ৯.৪৫ শতাংশে এসেছে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতেও কিছুটা হ্রাস পরিলক্ষিত হয় (১১.৬৬ থেকে ৮.৩৬ শতাংশ)।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কঠোর মুদ্রানীতি, উচ্চ সুদের হার এবং রফতানি আয় বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। তবে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও পরিবহন খরচের চাপ অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো বেশি।
প্রবৃদ্ধি মন্থর, বিনিয়োগে স্থবিরতা : দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (২০১৫-১৬ অর্থবছর ভিত্তি ধরে) ২০২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা ২০২৩ সালের ৫.৭৮ শতাংশ থেকে কমে এসেছে। এটি মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পর আবার এক ধরনের ‘স্ট্যাগন্যান্ট গ্রোথ’ পর্যায়ে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয়।
শিল্প ও এসএমই ঋণ বিতরণে পতন এ প্রবণতাকে আরো দৃঢ় করছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে শিল্পখাতে টার্ম লোন বিতরণ কমে এসেছে, যদিও ঋণ পুনরুদ্ধার সামান্য বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ অবস্থায় কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। যার মধ্যে বলা হয়েছে- ব্যাংকিং খাতের দ্রুত পুনর্গঠন করে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় শক্ত তদারকি, পুনর্গঠন নীতি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রফতানি বৈচিত্র্যকরণের লক্ষ্যে পোশাক খাতের বাইরে আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি ও হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে রফতানি বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত- রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার এনে ভ্যাট, কর ও শুল্ক প্রশাসনকে আধুনিকীকরণ করে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা জরুরি। চতুর্থত, স্মার্ট আমদানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে রিজার্ভ সুরক্ষা। পঞ্চমত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে নীতিগত ভারসাম্য আনাও জরুরি।