হিন্দুদের ওপর আক্রমণ রাজনৈতিক

Printed Edition

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) রুকন উদ্দিন

বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহাবস্থানের দেশ, যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ বসবাস করে। সাম্প্রতিক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা রাজনৈতিক কারণে ঘটতে পারে, তবে তা কখনোই সামগ্রিক ধর্মীয় সম্প্রীতির চিত্রকে প্রতিফলিত করে না। তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীরা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। সুতরাং, বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করার যেকোনো অপপ্রয়াস কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা এবং ভুল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা।

মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার এবং ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীরা খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সক্রিয়। এই বক্তব্য বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অশ্রদ্ধাসূচক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার একটি প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশের সমাজ বরাবরই শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও বহুত্ববাদী আদর্শে গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশটির সংবিধানে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাম্যের নীতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।

বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারি অর্থায়নে মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয় সংরক্ষণ, ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের জন্য অনুদান, শিক্ষাবৃত্তি ও কর্মসংস্থানে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সংখ্যালঘুদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক স্বার্থে বিকৃত করা উচিত নয়।

বাংলাদেশে কখনো কখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, তবে এটি ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে নয়; বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপূজা মণ্ডপে হামলা। এ ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে উসকে দেয়া হয়েছে। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা প্রমাণ করে- বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য বাস্তবতা-বিবর্জিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি অতীতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং বিজেপি-আরএসএসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার বাংলাদেশবিরোধী মন্তব্যও একই ধরনের একটি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অংশ, যা মূলত ভারতীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। তিনি একপক্ষীয় তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অসম্মান করেছেন এবং ভুল তথ্য প্রচারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার রুখতে সঠিক তথ্য প্রচার করা জরুরি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা ও সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে হবে। বিভ্রান্তিকর প্রচারণার বিরুদ্ধে কূটনৈতিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং গণমাধ্যমকে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের দেশ এবং এর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যেকোনো অপচেষ্টা রুখে দাঁড়ানো জরুরি। বিদেশী রাজনীতিকদের দায়িত্বশীলতার সাথে নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দেয়া উচিত, যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।

বাংলাদেশ সরকার চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সবসময় অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। চরমপন্থার বিরুদ্ধে সরকার যে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি অনুসরণ করছে, তা শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; বরং বাস্তবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৫ সালে জেএমবি (Jamaatul Mujahideen Bangladesh) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (ABT)-এর মতো উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেবল নিষিদ্ধ করাই নয়, এই সংগঠনগুলোর নেতাদের গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে।

বর্তমান সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে অত্যন্ত সজাগ। নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীর ও অন্যান্য উগ্রবাদী কোনো সংগঠন মাথাচাড়া দেয়ার কোনো সুযোগ দেশে এখন নেই। জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ, চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার রোধ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার রয়েছে।

বাংলাদেশ শুধু অভ্যন্তরীণভাবে নয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেও চরমপন্থা দমনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। জাতিসঙ্ঘ, ইন্টারপোল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে আর্থিক লেনদেনের উপর কঠোর নজরদারি চালানো হয়েছে, যার ফলে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর অর্থায়নের পথ বন্ধ রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার প্রচেষ্টা নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। কিছু আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে চরমপন্থার সাথে জড়িত দেখানোর চেষ্টা করে, যাতে দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা যায় এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ সৃষ্টি করা যায়।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো- সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারে এবং রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা, ঈস্টার সানডে- এমন ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সরকার আর্থিক অনুদান দেয় এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সংখ্যালঘুদের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় সংরক্ষিত কোটার ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে।

তুলনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক সহিংসতা ও বৈষম্যের হার অনেক বেশি, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সামাজিক সমর্থন পায়, যা তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়ানোর পেছনে কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও দেশের অভ্যন্তরের চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মিলে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, যাতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।

তাই, এ ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা, যাতে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে জবাব দেয়া যায়। গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের দেশ। এর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টা রুখে দাঁড়ানো জরুরি। বিদেশী রাজনীতিকদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দেয়া উচিত, যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।

বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দায়িত্বশীলভাবে তথ্য যাচাই করে মন্তব্য করা এবং ভুল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার অপচেষ্টা মাত্র।

বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। অতএব, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করার যেকোনো অপপ্রয়াস কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সত্য তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং ভুল তথ্যের প্রচার থেকে বিরত থাকা।

বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহাবস্থানের দেশ, যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ বসবাস করে। সাম্প্রতিক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা রাজনৈতিক কারণে ঘটতে পারে, তবে তা কখনোই সামগ্রিক ধর্মীয় সম্প্রীতির চিত্রকে প্রতিফলিত করে না। তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীরা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। সুতরাং, বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করার যেকোনো অপপ্রয়াস কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা এবং ভুল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক