ঢাকার মিটফোর্ডে পাথর মেরে হত্যা

স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্ত্রী, বরগুনায় শোকের ছায়া

জেলাবাসীর দাবি যেভাবে অপরাধীরা প্রকাশ্যে সোহাগকে হত্যা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে জড়িত খুনিদের প্রকাশ্যে বিচার করার।

গোলাম কিবরিয়া, বরগুনা
Printed Edition
বরগুনায় লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের স্ত্রী-সন্তানের সাথে স্বজনরা (ইনসেটে সোহাগ
বরগুনায় লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের স্ত্রী-সন্তানের সাথে স্বজনরা (ইনসেটে সোহাগ |নয়া দিগন্ত

পরিবারের চোখের অশ্রু আর আহাজারিতে পুরো বরিশাল বিভাগ যেন শোকস্তবদ্ধ। পাথরের উপর্যুপরি আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে, তখন কী নির্মম দৃশ্য; মেরে আবার লাশের উপর উল্লাস আর মুখের ওপর বিশ্রী আঘাত। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে উত্তাল বরগুনা। জেলাবাসীর দাবি যেভাবে অপরাধীরা প্রকাশ্যে সোহাগকে হত্যা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে জড়িত খুনিদের প্রকাশ্যে বিচার করার।

পাথর মেরে মেরে এ হত্যা জাহেলিয়াত যুগকেও হার মানিয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় লাল চাঁদ ওরফে মো: সোহাগ (৩৯) নামে এক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও পাথরখণ্ড দিয়ে বারবার মাথা ও শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বরগুনার সচেতন নাগরিক কমিটি ও বিভিন্ন সংগঠন এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে গতকাল বেলা ১১টায় শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

কে এই নিহত সোহাগ? : সোহাগের বয়স যখন মাত্র ৭ মাস তখন বজ্রপাতে মৃত্যু হয় তার বাবা আইউব আলীর। এর পর জীবিকার তাগিদে মা আলেয়া বেগম শিশু সোহাগ ও তার আরো দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে বরগুনা ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি দেন। ওই সময় থেকেই সোহাগ ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার মিডফোর্ডে মেসার্স সোহানা মেটাল নামের একটি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। জানা যায়, ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করেই অভিযুক্তদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় নিহত সোহাগের। একজন সফল ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। দীর্ঘদিন পুরান ঢাকায় ব্যবসা করে আসছেন। সোহাগের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নে। নানা বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার সাত নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড বান্দর গাছিয়া গ্রামে। তিনি একজন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী ছিলেন। নিহত সোহাগের চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়ে আছে, নাম সোহানা, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। আছে এগার বছর বয়সী একজন ছেলে সন্তান, নাম তার সোহান, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ঘরে রয়েছেন স্ত্রী ও শাশুড়ি।

সফল ভাঙ্গাড়ি ব্যবসা : লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ দীর্ঘদিন ধরে ভাঙাড়ি ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। অনেক পরিশ্রম করতে পারতেন তিনি। তাই এ ব্যবসায় তিনি সফলতার মুখ দেখেন। নিহত সোহাগ এক সময় পলাশ নামে একজনের অধীনে ভাঙাড়ি কেনাবেচার কাজ করতেন। গত চার-পাঁচ বছর আগে সোহাগ চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই এ ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় মহিন নামের একজনের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। সেই থেকে মাঝে মধ্যে এ বন্ধুর বাসায় তার আসা-যাওয়া। এমন কি যখন যেতেন তখন খাওয়া-দাওয়া করতেন। তবে কিছু দিন ধরে নিহত সোহাগের ভাঙ্গাড়ি ব্যবসার অর্ধেক ভাগ দাবি করে আসছিল মহিন। স্থানীয় যুবদল নেতা ‘পরিচয়’ দেয়া মহিনের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে নির্মম, বেদনা দায়ক জীবন দিয়ে পরপারে চলে যেতে হলো সোহাগকে।

পরিবারের আহাজারি : নৃশংস হত্যকাণ্ডের শিকার লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের নানা বাড়ি বরগুনায় চলছে স্বজনদের আহাজারি। এক দিকে স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্ত্রী লাকি বেগম। অপর দিকে ১১ বছরের ছেলে সোহান ও ১৪ বছরের মেয়ে সোহানাকে সান্ত¡না দেয়ার কোনো ভাষা জানা নেই তার। এ ঘটনায় বরগুনা জেলাজুড়ে চলছে শোকের মাতম।

বিচারের দাবিতে বরগুনায় মানববন্ধন : সোহাগ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের দাবি নিয়ে শহরে আয়োজিত মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ ও জেলার বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা। এ সময় বক্তারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, এটি একটি নারকীয় নৃশংসতা। এ ঘটনায় জড়িত খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। এই দেশে কোনো ঘটনা ভাইরাল না হলে বিচার হয় না, কেউ কথা বলে না। কিছু রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা চাঁদাবাজরা চাঁদা তুলে ভাগ দেয়, ধরা পড়লে দলের লোকজন তাদের বহিষ্কার করে মুখ বাঁচায়। ভাইরাল হলে তখন বিচারের নাটক হয়। বক্তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, এই নির্মম হত্যার বিচার যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।

নিহত পরিবারের আর্তনাদ : নিহত সোহাগের মেয়ে সোহানা ও ছেলে সোহান বলেন, চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন এতিম হয়ে গেছি, আমরা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। বাবাকে যারা হত্যা করেছে আমরা তাদের বিচার চাই।

সোহাগের বোন ফাতেমা বেগম বলেন, আমার ভাই প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছিলেন। প্রতি মাসে তার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা ছাড়াও ব্যবসাটাও নিয়ে নিতে চেয়েছেন অভিযুক্তরা। তবে আমার ভাই তাদেরকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তারা আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে মারধর করে এবং নির্মমভাবে পাথর মেরে হত্যা করে।

সোহাগের মামা মো: মন্টু মিয়া বলেন, সোহাগ অনেক ভালো ছেলে ছিল। তাকে যেভাবে মারা হয়েছে ওইভাবে কোনো পশুর সাথেও কেউ আচরণ করে না। যারা এ ধরনের কাজ করেছে, আমরা তাদের সঠিক বিচার চাই, ফাঁসি চাই।

নিহত সোহাগের স্ত্রী লাকি বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামীর দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন হত্যাকারীরা। আমার স্বামীর ব্যবসা তাদের সহ্য হচ্ছিল না। তারা প্রতি মাসে দুই লাখ করে টাকা চাইছিল। আমার স্বামী তা দিতে চায়নি। আর এ কারণেই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হতে হয়েছে তাকে।