ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও সীমাবদ্ধতার সাথে বাস্তবতার হিসাবও সামনে এনেছে। সম্মেলনের মূল বিতর্ক ছিল কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাধ্যতামূলকভাবে কমানো (ফেইজ আউট) নিয়ে। ১৯৪টি দেশ প্যারিস চুক্তির অধীনে একত্রিত হয়ে বিশ্ব উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হলেও প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে তেল উৎপাদনকারী সৌদি আরব ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এই প্রস্তাবকে বাধ্যতামূলক না রেখে ‘স্বেচ্ছামূলক’ করার পক্ষে অবস্থান নেয়। জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রগতি অব্যাহত, তবে প্রতিটি দেশের বাস্তব প্রয়াস আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করবে।’ এটি জলবায়ুসঙ্কট মোকাবেলায় সীমিত প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দেয়।
কপ৩০-এর আলোচ্যসূচি মূলত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নের ওপর কেন্দ্রিত ছিল। প্যারিস চুক্তি ২০১৫ সালে গৃহীত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য বিশ্ব উষ্ণতা সীমাবদ্ধ রাখা, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন সহায়তা নিশ্চিত করা। কপ৩০-এর মাধ্যমে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, কোটি কোটি হেক্টর বন ও ভূমি সংরক্ষণ এবং ৪০ কোটিরও বেশি মানুষের সহনশীলতা বৃদ্ধির পদক্ষেপের আভাস পাওয়া গেছে। তবে চূড়ান্ত খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটকে বাধ্যতামূলক না রাখার সিদ্ধান্ত তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর চাপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে বাস্তবায়নকে সীমিত করেছে।
১০ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেম নগরীতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (ক৩০) শুরু হয়, ২১ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক দিন বাড়ানো হয়। ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে শেষ হয় কপ৩০-এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এ দিন রাতে সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল সমাপনী বক্তব্যে জানান, অংশগ্রহণকারী দেশগুলো ন্যায্য উত্তরণ, লিঙ্গ সমতা এবং অভিযোজন অর্থায়ন তিনগুণ বৃদ্ধি করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, এই পদক্ষেপগুলো দুর্বল, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রমিক, নারী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের রোডম্যাপকে জাতিসঙ্ঘের কার্যক্রমের বাইরে রাখার ফলে তা স্বেচ্ছাস্বীকৃত ও অপ্রতিশ্রুতিমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বজুড়ে দেশগুলো পরিবেশ রক্ষা, জাতীয় স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো, যেখানে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, চরম বন্যা এবং কৃষিক্ষতির ঝুঁকি ক্রমবর্ধমান, সেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অভিযোজন অর্থায়ন বিশেষ গুরুত্ব পায়। কপ৩০-এর আলোচ্য পাঠ্য ও অ্যাকশন এজেন্ডা বাংলাদেশের জলবায়ু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে। তবে এর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় নীতি সমন্বয় অপরিহার্য।
কপ৩০-এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল- কিছু দেশের প্রত্যাশা ও বাস্তবায়নের গতি। কিছু দেশ দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণ, অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবেলায় ত্বরান্বিত পদক্ষেপ চেয়েছিল। সাইমন স্টিল আশ্বস্ত করেছেন যে, দিকনির্দেশনা স্থির, তবে বাস্তবায়নে ধাপের মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন, ধাপে ধাপে, কপ থেকে কপ-এ একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তুলছি, যা কোটি কোটি মানুষের জন্য কার্যকর।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কপ৩০-এর ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে আগামী ২০ বছরে নদীভাঙন, চরম বৃষ্টিপাত এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। কপ৩০-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোজন অর্থায়ন বৃদ্ধি, বন ও ভূমি পুনরুদ্ধার এবং পরিচ্ছন্ন শক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা পাওয়া সম্ভব। এটি বিশেষভাবে কৃষি, মৎস্য, পানি ব্যবস্থাপনা এবং নগর পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, কোটি কোটি হেক্টর সংরক্ষিত বন ও ভূমি এবং ৪০ কোটিরও বেশি মানুষের সহনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিশ্চিত করেছে, তাদের জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করা হবে। তবে এ পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে ২০২৬ সাল থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক তহবিল কার্যকর হবে, যা অনেক দেশকে তাদের বর্তমান জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সীমিত সহায়তা দেবে।
কপ৩০-এ আদিবাসী অধিকার ও ন্যায্য রূপান্তরের অগ্রগতি স্বীকৃত হলেও আদিবাসী জনগণ এখনো হুমকিস্বরূপ অবস্থা মোকাবেলা করছে। প্রায় দুই হাজার ৫০০ আদিবাসী অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘আদিবাসী কপ’ ও ‘আমাজনিয়ান কপ’ আখ্যাপ্রাপ্ত এই সম্মেলন তাদের অন্তর্ভুক্তি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার দিকে এগিয়েছে। ‘জাস্ট ট্রানজিশন মেকানিজম’ গ্রহণে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার রক্ষা এবং সবুজ অর্থনীতিতে স্থানান্তর নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও পর্যাপ্ত অর্থায়ন চূড়ান্ত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্ট্রেলিয়ার ভূমিকা নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। দেশটি স্বেচ্ছাস্বীকৃত চুক্তিতে সই করলেও বাস্তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দ্রুত উত্তরণে দ্বৈততা বজায় রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশটি নতুন গ্যাস প্রকল্প চালু রাখার পরিকল্পনা করছে, যা জলবায়ু উদ্যোগের বিরোধী। এ ছাড়া ৯০টিরও বেশি দেশ স্বেচ্ছাস্বীকৃত চুক্তিতে সই করলেও জাতিসঙ্ঘের কার্যক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই কারণে কপ৩০-এর অর্জন সীমিত এবং কপ৩০-এর বাস্তব পদক্ষেপের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপ, যেমন বন সংরক্ষণ ও নির্দিষ্ট অভিযোজন অর্থায়ন বৃদ্ধি করা হলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমারেখা রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। তেলভিত্তিক দেশগুলো ও শিল্প লবিস্টদের চাপের কারণে চূড়ান্ত চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে কপ৩০-এর সীমিত অর্জন এবং পর্যাপ্ত বাস্তবায়নের অভাব পরবর্তী সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
সিমন স্টিলের আশ্বাস এবং বেলেমের ঘোষণার মধ্যেও দেখা যায়, কপ৩০-এর আশা অনুযায়ী শক্তিশালী, বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। তবে এটি একটি নতুন বৈশ্বিক আলোচনা ও কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু নীতি, অভিযোজন কার্যক্রম এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা পরিকল্পনায় দিকনির্দেশনা পাবে। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং নবায়নযোগ্য শক্তির বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ঝুঁকি হ্রাস, কৃষি ও নদী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। কপ৩০-এর অর্জন বাংলাদেশকে আরো স্থিতিশীল, বাসযোগ্য এবং জলবায়ু সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর করবে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বেলেমের কপ৩০-এর সীমিত সাফল্য সত্ত্বেও বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। জলবায়ু নীতি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও অর্থায়ন ছাড়া কোনো দেশই ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষম হবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার যুগ্ম সম্পাদক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ‘জাস্ট ট্রানজিশন মেকানিজম’ এবং ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফ্যাসিলিটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হলেও আরো দ্রুত, বড় এবং বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কপ৩০-এ আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে।



