সিলেট-নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড কোনো কাজেই আসছে না

বজ্রপাতে ১০ বছরে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু

আবদুল কাদের তাপাদার, সিলেট ব্যুরো

Location :

Sylhet
Printed Edition
বজ্রপাত নিরোধক দণ্ডের চেয়ে হাওরে এরকম আশ্রয়কেন্দ্রের দাবি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে
বজ্রপাত নিরোধক দণ্ডের চেয়ে হাওরে এরকম আশ্রয়কেন্দ্রের দাবি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে |নয়া দিগন্ত

কোনো কাজেই আসছে না হাওরাঞ্চলে স্থাপিত ব্যয়বহুল লাইটিনিং অ্যারেস্টার মেশিন বা বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড। প্রতি বছরই বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। উপরের তিন জেলা ও নেত্রকোনা জেলায় প্রায় আট কোটি টাকায় এই দণ্ড বসায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। ব্যয়বহুল এই দণ্ডটি হাওরাঞ্চলের যথাস্থানে না বসিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ভবন ও মুজিব পল্লীতে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড হাওরাঞ্চলের মানুষের তেমন কোনো কাজে লাগেনি। অভিযোগ উঠেছে যেনতেনভাবে, যেখানে-সেখানে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন করে প্রকল্পের অধিকাংশ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তদুপরি স্থাপিত দণ্ডগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে। গবেষকরা বলছেন, বজ্রপাত থেকে বাঁচতে দণ্ডের ওপর নির্ভরশীলতা অর্থের অপচয়। এ ক্ষেত্রে হাওরাঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নির্মাণ করতে হবে আশ্রয়স্থল।

দেশের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ হাওর এলাকা সুনামগঞ্জে তিন বছর আগে বসানো হয় লাইটিনিং অ্যারেস্টার বা বজ্রনিরোধক দণ্ড। বলা হয়, ১০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে নামিয়ে আনে এই দণ্ড, কমায় প্রাণহানি। তবে দুই কোটি টাকা খরচ করে জেলার ছয় উপজেলায় ১৮টি লাইটিনিং অ্যারেস্টার মেশিন বসানো হয়। দণ্ডটি নির্জন হাওরে না বসিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ অফিস এলাকায় বসানো হয়েছে। আর যথাস্থানে না বসানোর কারণে এবং তদারকির অভাবে তা এখন কোনো কাজেই আসছে না। পাঁচ বছর আগে হবিগঞ্জের ৯ উপজেলায় দুই কোটি টাকায় বসানো হয় তামা-অ্যালুমিনিয়ামের এই ধাতব দণ্ড। সেখানেও একই চিত্র। এ দিকে, দেড় কোটি টাকা খরচ করে মৌলভীবাজারে সাত উপজেলায় বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি।

সুনামগঞ্জ জেলার পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা জেলায় একই ভাবে দুই কোটি টাকার বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড বসানো হয় সেখানেই একই চিত্র দেখা গেছে।

জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ শাহ সজিব আহমদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মোট বজ্রপাতের ৭০ ভাগই ঘটে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। বজ্রপাত থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায় ঝড় শুরুর আগেই হাওর অথবা খোলা মাঠ ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া।

দেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জে। হাওরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষই বেশি শিকার হচ্ছে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড এবং অসচেতনতার কারণে দিন দিন বাড়ছে বজ্রপাত আতঙ্ক। এ জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়াও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবিও জানিয়েছেন কেউ কেউ। চলতি প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল-মে) সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দিরাইয়ে দুইজন, শাল্লায় একজন, শান্তিগঞ্জে একজন, ছাতকে একজন ও দোয়ারাবাজারে একজন।

হিলিয়ান জার্নালে প্রকাশিত ‘জিআইএস-বেজড স্পেশাল অ্যানালাইসিস ফর লাইটিনিং সিনারিও ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় জানা গেছে, গেল বছর সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে ১১ জন ও ২০২৩ সালে ১২ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫-২০২২ সাল পর্যন্ত আট বছরে বজ্রপাতে ১৪০ জন মারা গেছে এ জেলায়।

বজ্রপাতে বেশি মারা যায় কৃষক ও জেলে। চৈত্র থেকে আষাঢ় (মার্চ-মে) মাস পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে খুব বজ্রবৃষ্টি হয়। এ সময় বোরো ফসল ঘরে তুলতে দিনরাত হাওরেই পড়ে থাকতে হয় কৃষকের। এরপর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিকে গোটা হাওরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। তখন ওই এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ জীবিকার তাগিদে মাছ ধরতে হাওরে বের হয়। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে দ্রুত কৃষক-জেলে কেউই নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে পারে না। যে কারণে বজ্রপাতের শিকার হয়ে মারা যায় অনেকে। বজ্রপাতসহ প্রকৃতিগত যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় হাওরের প্রতিটি স্পটে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের তাগিদ অনেকের।

সিলেট আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ শাহ মো: সজিব হোসাইন বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় করণীয় বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, টেকনোলজি কিংবা প্রযুক্তির বাইরে গিয়ে কিভাবে বজ্রঝুঁকি কমানো যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। পশ্চিম আকাশে মেঘের রঙ কালো দেখলেই মাঠে-ঘাটে থাকা যাবে না। এই শর্তটা সবাইকে মানতে হবে। আপনার জীবন আপনাকে বাঁচাতে হবে। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতার বিকল্প নেই। আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটে থাকা নির্দেশনা দেখেও সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এই আবহাওয়াবিদ। বিশেষ করে কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, যারা মাঠে থাকবেন তারা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নিচু হয়ে কানে হাত দিয়ে বসে থাকবেন। আর যারা নৌকায় থাকবেন তারা অবশ্যই বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত নৌকার ছাউনির (ছই) ভেতরে অবস্থান নেবেন।

একই রকম পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ভৌগোলিক কারণে হাওর এলাকায় বজ্রপাত বেশি হয়। খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও মেঘালয় পাহাড়ে মার্চ-মে মাসজুড়ে মেঘ জমে থাকে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে পাহাড়ের পাদদেশ সুনামগঞ্জে বজ্রপাত আতঙ্ক বেশি। বজ্রপাত থেকে জীবন বাঁচানোর কৌশল হিসেবে তিনি বলেন, বজ্রপাত উঁচু গাছপালা কিংবা উঁচু স্থানে প্রথম আঘাত হানে। তাই গাছের নিচে থাকা ঠিক হবে না। খোলা জানালা, খোলা বারান্দা থেকে দূরে থাকাটা নিরাপদ। বজ্রপাতের সময় ইলেকট্র্রনিক জিনিস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সচেতনতার তাগিদ দিয়ে তিনি আরো বলেন, নির্দিষ্ট দূরত্বে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের পাশাপাশি দুর্গম হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ জরুরি। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলে জলসহিষ্ণু গাছ রোপণ করতে হবে। সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত জেলা হলেও সেখানে আবহাওয়া অধিদফতর নেই। আবহাওয়া অধিদফতর থাকলে বজ্রপাত সংক্রান্ত আগাম সতর্কবার্তা সবাই জানতে পারত। এটা হলে প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হতো।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো: আনোয়ারুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রায় আশি ভাগ সুনামগঞ্জে ঘটে। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু সুনামগঞ্জের উপরে এসে মেঘালয় পর্বতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে বায়ুতে উষ্ণতা (তাপমাত্রা) বেশি থাকে। ওই গরম বায়ুতে সংঘর্ষ হওয়ায় আলোর বিস্ফোরণ ঘটে এবং বজ্রপাত হয়। তিনি বলেন, সূর্য আমাদের যে তাপ (গরম) দিচ্ছে সেটা ফিরে যাওয়ার জায়গা পাচ্ছে না। সেই তাপমাত্রা মূলত পৃথিবীর উপরে থাকা ওজোন স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে। তাপমাত্রা বেশি হলে জলীয়বাষ্প কিংবা বায়ুদূষণও বেশি হয়, যা বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করে। একসময় পুরো বর্ষাকালজুড়েই বৃষ্টি হতো। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন সেটা হচ্ছে না। মূলত তাপমাত্রা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। তিনি আরো বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে গত ৩০ বছরে প্রায় ষাট ভাগ ভূমির ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। অপরিকল্পিত হাওর রক্ষা বাঁধ, রাস্তাঘাট, অতিরিক্ত নদীশাসনে জলাধার কমে যাওয়ার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জলবায়ু পরিবর্তনকে উৎসাহিত করছে। যে কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বজ্রপাত বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বজ্রপাত হবে। এটা রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, গবেষকসহ সবাইকে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বজ্রপাতের সম্ভাব্য সময়ে গাছের নিচে থাকা যাবে না। এ সময় ক্ষেতে-মাঠে কাজ করা লোকজন যেন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে সেই সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। তাতে প্রায় আশি ভাগ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব।

দেশে দুর্যোগ গবেষণাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডিজাস্টার ফোরামের হিসেবে, ২০১০-২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে চার হাজারেরও বেশি মানুষের। আর জাতিসঙ্ঘের হিসাবে বজ্রপাতে বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়।