নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- গাজায় নতুন বিপদ অবিস্ফোরিত বোমা
- রাফা ক্রসিং খুলছে ইসরাইল
- গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৭,৯৩৮
- হামাসকে নিরস্ত্র হতে বাধ্য করতে চান ট্রাম্প
যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। গতকাল বুধবার তারা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান থেকে গুলিবর্ষণ করেছে। ফিলিস্তিনের ওয়াফা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, গাজা শহরের পূর্বে, খান ইউনুসের পূর্বে, বানি সুহাইলা শহর এবং শেখ নাসের পাড়ায় বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে দখলদার সামরিক ট্যাঙ্কগুলো কামানের গোলাবর্ষণ করে। তা ছাড়া গতকাল বুধবারেও ইসরাইলি হামলায় দুইজন ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে আশ শিফা হাসপাতাল।
ওয়াফা নিউজ এজেন্সি আরো জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৪৪ জন ফিলিস্তিনির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একই সময়ে ২৯ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। হাজার হাজার ভুক্তভোগী এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অ্যাম্বুলেন্স এবং সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।
গাজায় নতুন বিপদ অবিস্ফোরিত বোমা : যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ফেরত আসা মানুষের জন্য নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে বিপুল পরিমাণ অবিস্ফোরিত বোমা। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যেকোনো মুহূর্তে এসব বিস্ফোরক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গাজা শহরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাইন ও বিস্ফোরকমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি জানায়, বেসরকারি সংস্থা হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজার সাধারণ নাগরিকরা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। সংস্থাটির হিসাবে, যুদ্ধ চলাকালে গাজার ওপর প্রায় ৭০ হাজার টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মাইন ও অবিস্ফোরিত গোলা অপসারণে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পরিচালক অ্যান-ক্লেয়ার ইয়াইশ বলেন, গাজায় যে ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ড ঘটেছে, তাতে স্তরে স্তরে ধ্বংসস্তূপ জমে আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত জটিলতা, যা পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনক করে তুলেছে।
জাতিসঙ্ঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিস জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, গাজায় নিক্ষিপ্ত মোট বিস্ফোরকের ৫ থেকে ১০ শতাংশ এখনো ফাটেনি। সংস্থাটি জানায়, টানা দুই বছরের অবরোধের কারণে তাদের প্রতিনিধিদল এখনো পর্যন্ত গাজায় প্রবেশ করে বৃহৎ পরিসরে সমীক্ষা চালাতে পারেনি। ফলে অবিস্ফোরিত অস্ত্রের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব হয়নি। ইউএনএমএএস জানায়, আগামী দিনে তাদের মূল মনোযোগ থাকবে ধ্বংসস্তূপ অপসারণে, যাতে নিরাপদ উদ্ধার ও পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নেয়া যায়। বিশেষ করে যেসব সড়ক দিয়ে হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষ ঘরে ফিরছেন, সেসব সড়কের পাশে জমে থাকা ধ্বংসাবশেষ দ্রুত সরিয়ে ফেলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। জাতিসঙ্ঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক কার্যালয় জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে বিস্ফোরক থাকার আশঙ্কা রয়েছে। অল্পসংখ্যক সাঁজোয়া যান থাকায় সীমিত পরিসরে নিরাপত্তা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থা জানিয়েছে, এখনো তারা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি যার মাধ্যমে অবিস্ফোরিত বোমা ধ্বংসের সরঞ্জাম গাজায় প্রবেশ করানো সম্ভব হবে। ইউএনএমএএস বলেছে, তাদের তিনটি সাঁজোয়া যান গাজার সীমান্তে অপেক্ষমাণ রয়েছে। অনুমতি পেলেই বড় পরিসরে নিরাপদ অপসারণ অভিযান শুরু করা হবে। এ দিকে জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি জানিয়েছে, গাজার পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে ৭০ বিলিয়ন ডলার। দুই বছরব্যাপী যুদ্ধের ফলে ইতোমধ্যে প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ জমে আছে, যা সরিয়ে ফেলা এখন গাজার পুনর্জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
হামাসকে নিরস্ত্র হতে বাধ্য করতে চান ট্রাম্প : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস নিজেদের অস্ত্র ফেলে না দিলে তাদের নিরস্ত্র করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে গাজা যুদ্ধবিরতির চুক্তি উদযাপন করার একদিন পরেই মঙ্গলবার ট্রাম্প এই হুঁশিয়ারি দেন। দ্য গার্ডিয়ান ও রয়টার্স জানায়, তিনি বলেন, হামাস যদি অস্ত্র না ফেলে, তবে আমরাই তাদের নিরস্ত্র করব। তারা জানে আমি খেলা খেলছি না। এটা খুব দ্রুত হবে এবং সম্ভবত সহিংসভাবেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প আরো বলেন, আমি হামাসকে বলেছি, তোমরা নিরস্ত্র হবে এবং তারা বলেছে, জি স্যার, আমরা নিরস্ত্র হব। তিনি জানান, এই বার্তা তিনি সরাসরি নয় বরং আমার লোকদের মাধ্যমে হামাসের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেননি, হামাসকে নিরস্ত্র করার ক্ষেত্রে কারা অংশ নেবে বা এতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী জড়িত থাকবে কি না।
হামাস এখন পর্যন্ত অস্ত্র ছাড়তে রাজি হয়নি, যদিও এটি ট্রাম্পের ২০-দফা যুদ্ধবিরতি ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশাল’-এ লেখেন, ২০ জন জীবিত বন্দী সবাই ফিরে এসেছে এবং তারা যতটা ভালো থাকা সম্ভব, ততটাই ভালো আছে। এক বিশাল বোঝা নামিয়ে রাখা গেছে। তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। যেভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেইভাবে মৃতদের লাশ ফেরত দেয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধাপ এখনই শুরু হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে ট্রাম্প একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক ভোর ঘোষণা দেন।
এই সফরে তিনি ও আঞ্চলিক নেতারা গাজা যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে স্থায়ী করতে এক যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। এ দিকে গাজার একটি হাসপাতাল জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরাইল ৪৫ জন ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দিয়েছে।
রাফা ক্রসিং খুলছে ইসরাইল : নতুন চার বন্দীর লাশ ফেরত পাওয়ার পর ইসরাইলও তাদের আগের সিদ্ধান্ত বদলে রাফা ক্রসিং খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ইসরাইলি সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবরের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। হামাস লাশ ফেরত দিতে দেরি করছে অভিযোগ করে প্রতিদিন গাজায় সর্বোচ্চ ৩০০টি ট্রাক ঢোকার অনুমতি দেয়ার হুমকি থেকেও সরে এসেছে তারা। চুক্তি অনুযায়ী গাজায় প্রতিদিন ত্রাণবাহী ৬০০ ট্রাক ঢুকতে দেয়ার কথা।
গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৭,৯৩৮ : গাজার বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে আরো ২৫ জনের লাশ পৌঁছেছে, যার মধ্যে ১৬ জনের লাশ ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং একজন আহত অবস্থায় মারা গেছেন। এ ছাড়া আহত অবস্থায় আরো ৩৫ জনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইলি হামলায় গাজা উপত্যকায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৭,৯৩৮ জন নিহত এবং ১,৭০,১৬৯ জন আহত হয়েছেন। টেলিগ্রামে প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, এখনো বহু লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছে, যাদের উদ্ধার করতে পারেনি অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্স টিমগুলো।
গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর ঘোষণা ট্রাম্পের : যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত চুক্তির প্রথম পর্যায়ে ২০ জন ইসরাইলি পণবন্দীকে মুক্তি দেয়ার পর মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির ‘দ্বিতীয় ধাপ’ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। খবর আনাদোলু অ্যাজেন্সির। যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ অনুযায়ী, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে বন্দিবিনিময় হয়েছে। ২০ জন ইসরাইলি পণবন্দীর বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে ইসরাইলের ওফার সামরিক কারাগার ও নেগেভের অন্যান্য কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
ট্রাম্প ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি সোমবার মিসরের শারম আল-শেখে একটি উচ্চপর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনটিতে ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্ব নেতাদের একত্র করা হয়। মার্কিন চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে গাজায় একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন এবং হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।



