- বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা
- দুঃসহ হচ্ছে তাপমাত্রা
দখল হচ্ছে নদী। উজাড় হচ্ছে বন। অনিয়ন্ত্রিত ময়লা-আবর্জনায় গতি হারাচ্ছে নদী। পাহাড় কেটে হচ্ছে স্থাপনা। হাওরের বাঁধে কমছে পানিপ্রবাহ। এসব নানান কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ভয়াল হয়ে উঠছে প্রকৃতি। এতে দিন দিন বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা বাড়ছে। সেই সাথে দানব হয়ে উঠছে তাপমাত্রা, শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। অসময়ে দেখা দিচ্ছে খরা, বন্যা। বছরে দুই থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে ভূগর্ভের পানির স্তর। বাড়ছে ভূমিকম্পের আশঙ্কা। বিষাক্ত হয়ে পড়া নদীর পানিতে খাদ্যে বিষ ছড়াচ্ছে। তাতে করে দিন দিন মানুষের জীবনে ঝুঁকি বাড়ছে। তাপের অসহনীয় তীব্রতায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছিল শীর্ষে। কিন্তু বিগত ৫২ বছর পর ২৪ সালের মে মাসে দেশের তাপমাত্রা ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠে ৭২ সালকে স্পর্শ করে। এর আগে ১৯৯৫ সালের পয়লা মে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের অসহনীয়তার পর চলতি বছরও স্বস্তি নেই। যার ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে এপ্রিল মাসে। এর গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মে মাস হলো দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ মাস। এ সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ৩২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
অন্য দিকে গবেষকরা বলছেন, প্রতি বছর ঢাকায় পানির স্তর ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। বায়ুদূষণেও গেল বছর প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছে ঢাকা নগরী। বিগত ৯ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস বায়ুদূষণের দিক থেকে ছিল শীর্ষে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি ছিল। অন্য দিকে সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে সবুজায়ন উজাড় করে প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। দেশের প্রায় এক হাজার ২০০ নদী থাকলেও দখল-দূষণে তা এখন প্রায় চার শতে এসে ঠেকেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সাথে উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান দায়ী মন্তব্য করে তারা বলেন, এর বাইরে জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পকারখানা থেকে কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, জলবায়ুর ওপর সমুদ্রের প্রভাব, সবুজায়ন ধ্বংস, নদী, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এসব কারণে বিগত ৫০ বছর ধরে দেশে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। যা আগামী চার বছরের মধ্যে আরো দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে।
বেসরকারি গবেষণা বলছে, সামনের পাঁচ বছরের মধ্যে ৪৫ ডিগ্রি এবং ২৫ বছরে গরমের মাত্রা ৪৬ ডিগ্রি ছাড়াবে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো বলছে আগামীতে বাংলাদেশের তাপমাত্রা দৈনিক গড় উষ্ণায়নের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে এবং শীতকালে তাপমাত্রা ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের তাদের গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে জানায়, গত প্রায় চার যুগে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই গড় তাপমাত্রা আরো দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে পরিবেশবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। নষ্ট হচ্ছে ইকো সিস্টেম। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। জলাভূমি হচ্ছে মরুভূমি। জলবায়ু প্রভাবে ভয়াবহ বন্যার সাথে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় যখন তখন ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মৃত্যু বাড়ছে।
আরেক পরিবেশবিজ্ঞানী ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, যে কয়েকটি কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে তার অন্যতম হলো সবুজায়ন ধ্বংস, নদী, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয় কমে আসা ছাড়াও বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় কারণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে তাপদাহ দেখা যাচ্ছে সেটি দীর্ঘ দিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও এখন আর তা নেই। কারণ গাছপালা যেহেতু কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখত; কিন্তু বন উজাড় করায় বৃক্ষ কমে গিয়ে এখন অক্সিজেন, জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে।
অন্য দিকে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের চেয়ারপারসন ও সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, যদি তাপদাহের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তবে ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আমাদের জন্য অসহনীয় হবে। এর নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উপায় গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানোর মাধ্যমে তাপপ্রবাহপ্রবণতা কমানো।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিøক নয়া দিগন্তকে বলেন, এলনিনোর প্রভাবে সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তার মতে, এভাবে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে গাছপালা বিলীন এবং শস্য আবাদে চরম ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব এর মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ভূ-পৃষ্ঠে পানির রিজার্ভার বাড়াতে খাল খনন, পুকুর খনন ও সংস্কার করতে হবে। সেই সাথে গাছপালা বাড়ানো গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা হলেও মোকাবেলা সম্ভব হবে।