জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির রায়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ। তার খালাসের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, বস্তুগত প্রমাণ এবং দাখিল করা আইনি যুক্তিতর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়নের পর আপিল বিভাগ বিবেচনা করছে যে, এ টি এম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করা ছিল ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা। যার ফলে ন্যায়বিচারের চরম অবহেলা ঘটেছে।
জামায়াতের যেসব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে যে অবৈধ শাস্তি দেয়া হয়েছে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাসের রায়ের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
গতকাল জামায়াতের সাবেক আমির শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহান, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ও সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলীর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
প্রহসনের রায়ের সাথে জড়িতদের বিচার করতে হবে : ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন। প্রদান করা রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন গতকাল নয়া দিগন্তকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাসের রায়ের জন্য সরকার ও আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে চাই, শুধু দুঃখপ্রকাশই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এতে যাদের প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে তাদের ফেরত পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া এ টি এম আজহারুল ইসলাম যে গত ১৫ বছর ধরে কারারুদ্ধ থাকলেন, মুক্ত জীবন থেকে বঞ্চিত হলেন এর জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ছাড়া যারা বিচারের নামে তামাশা করেছেন, প্রহসনের বিচার করেছেন, সেই বিচারের সাথে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের সংশ্লিষ্টরা, ঘটনার সাথে জড়িত বিচারক, প্রসিকিউশন, সাক্ষী সবাইকেই বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটা ন্যায় বিচারের জন্য জরুরি বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, রায়ে আদালত স্বীকার করেছেন মৃত্যুদণ্ডের আগের যে রায় ছিল তা বিচারিক হত্যাকাণ্ড ও প্রহসনের রায় ছিল।
এ রকম একটি রায় আমার বাবার ক্ষেত্রেও আশা করেছিলাম: আলী আহমাদ মাবরুর
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন। এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর গতকাল নয়া দিগন্তকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রথমত আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদুলিল্লাহ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাসের রায় প্রদান করেছেন। আমরা আনন্দিত যে আমার বাবার রাজনৈতিক সহকর্মী, যিনি আমাদের বাবার মতোই, তিনি মুক্তি পেয়েছেন। এটি একটি ইতিবাচক রায় হয়েছে, যা আমাদের জন্য স্বস্তির। একই সাথে আমাদের কষ্ট দিচ্ছে যে, এ রকম একটি রায় আমার বাবার ক্ষেত্রেও আশা করেছিলাম। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ^াস করি যে, আজকে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইন আমার বাবার ক্ষেত্রে প্রতিপালন করা হয়নি। এ ছাড়া মামলায় যেসব অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো যদি যথাযথভাবে বিবেচনায় নেয়া হতো যেভাবে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছে, এটা যদি না করা হতো তাহলে আমরা বিশ^াস করি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ বেকসুর খালাস পেতেন। আমরা আশা করছি আইনজীবীরা এ ব্যাপারে আমাদের গাইড করবেন।
সরকারের উচিত অতীতের মামলার রায়গুলো রিভিউয়ে কমিশন গঠন : ব্যারিস্টার আরমান
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এই রায়েই প্রমাণিত হলো আগে যেসব রায় দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্দোষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো ছিল ভ্রান্ত এমন মন্তব্য করেছেন শহীদ মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিষ্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান। তিনি বলেন, আগের রায়গুলো আইন অনুযায়ী হয়নি। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে হয়নি। আমরা আশা করব অন্তর্বর্তী সরকার অতীতে যেসব রায় হয়েছে সেগুলোকে রিভিউ করার জন্য কমিশন গঠন করবেন। সেটা না করলে আমরা রায়ের রিভিউ চেয়ে রিট পিটিশন করব।
এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাসের রায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যারিষ্টার আরমান বলেন, পূর্ববর্তী রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। এই গুরুতর বিচ্যুতি বিচারব্যবস্থায় এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, অতীতের সবগুলো মামলাই রিভিউযোগ্য। আমরা ওই সব মামলার রিভিউ চাচ্ছি বর্তমান সরকারের কাছে। কারণ অতীতের রায়গুলো বিচারিক ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে। অতীতের রায়গুলোতে সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা ছাড়াই ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল। তাদের ওপর জুলুম করা হয়েছিল। জুলুম করে অতীতে মিথ্যা, সাজানো ও পাতানো মামলায় এবং মিথ্যা সাক্ষী প্রদানের মাধ্যমে কার্যত জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে।
জামায়াত নেতাদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে : মাসুদ সাঈদী
জামায়াতের সাবেক সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, জামায়াত নেতাদের যে কোর্টে বিচারের মাধ্যমে অবৈধভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তা ছিল মূলত একটি ক্যাঙ্গারু কোর্ট। এখানে আমরা কোনো কাগজপত্র এবং দলিল উপস্থাপন করতে পারেনি। এখানে কোনো সাক্ষী উপস্থিত করার সুযোগ ছিল না। আমরা যখন কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করার চেষ্টা করতাম তখন সাক্ষীকেই গুম করে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ইসলামী আন্দোলনকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে। এখানে বিচারের নামে শেখ হাসিনা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। ৫ আগস্টে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব জায়গায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে আদালত নির্দোষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাকে সাজা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, কামরুজ্জামান এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ যেসব জামায়াত নেতাদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছিল তারা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তারা আজ অবশ্যই ন্যায়বিচার পেতেন এবং তাদের মামলাগুলো মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ হতো।
অন্যায়ভাবে শাস্তিদাতাদের বিচারের আওতায় আনা হোক : মিনহাজুল আবেদীন নান্নু
জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহানের ছেলে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেন, আমার বাবাসহ মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল বা অভিযোগ দায়ের করেছিল তা প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের হিংসা চরিতার্থের জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট ছিল। এর সাক্ষী, প্রসিকিউটর ও বিচারক সবাই মিথ্যা সাক্ষী ও রায় দিয়ে মুরুব্বিদের হত্যা করে। আমরা চাই এ টি এম আজহারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ব্যক্তি বিশেষ বা পরিকল্পনাকারী জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা হোক। আর কেউ যেন মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে এ ধরনের প্রতিহিংসার শিকার না হোক।
পরিবারগুলোকে মিথ্যার দায় মুক্ত করা হোক : হাসান ইমাম ওয়াফী
জামায়াতের সাবেক সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইমাম ওয়াফী তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এ টি এম আজহার সাহেবের ট্রাইব্যুনালের মিথ্যা মামলায় খালাস পাওয়ায় আমরা শুকরিয়া আদায় করছি। এখন আমরা দাবি জানাই আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের সমন্বয়ে একটা কমিশন করে এ টি এম আজহারুল ইসলামের মামলার রায়ের আলোকে পূর্বের মামলাগুলোর পুরো প্রসিডিং পুনরায় এসেসমেন্ট করা যেতে পারে। এতে করে ন্যায়বিচার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেহেতু আমার বাবাসহ যাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে দলীয় নেতা হিসেবে তাই দল থেকেই উদ্যোগ নিয়ে পরিবারগুলোকে দায়মুক্ত হতে সাহায্য করতে হবে।
নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে নতুন করে বিচার শুরু করা হোক: হাসান জামিল
জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল গতকাল নয়া দিগন্তকে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যে রায় আমরা পেলাম, তাতে এটি আবারো প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলো যে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাসহ জামায়াতের যেসব শীর্ষ নেতাকে তথাকথিত ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে যে বিচার করা হয়েছিল, তা ছিল ইসলামী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা ও পার্শ্ববর্তী একটি দেশের আধিপত্যকে এ দেশে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। জাতিসঙ্ঘসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এই বিচারের নানা ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরা সত্ত্বেও হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার তথাকথিত বিচারের নামে আব্দুল কাদের মোল্লাসহ জামায়াতের অন্যান্য শীর্ষ নেতাকে বিচারের নামে হত্যা করে। এটি সুস্পষ্টভাবেই একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সম্প্রতি ব্রিটেনের একটি আদালত বলেছে যে, এই বিচারের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের গণহত্যা করা হয়েছে। শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের দেশ, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারবিরোধী দাবিকে আমলে নিয়ে যেভাবে আইনকে সংশোধন করে আইনের মাধ্যমে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে পরবর্তীতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে, তা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।