ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পরে বিএনপির নাম ব্যবহার করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ণ করে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন অনেক অসাধু ব্যক্তি। শুরু থেকে এসব অসাধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে দলীয় হাইকমান্ড শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও অনেকেই রয়েছেন আড়ালে। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৫ আগস্টের আগে যারা আওয়ামী লীগের সাথে মিলেমিশে নির্বিঘে্ণ ব্যবসাবাণিজ্য করেছেন বিভিন্ন স্থানে তারাই এখন বিএনপির ‘হর্তাকর্তা’। তাদের সাথে যোগ হয়েছেন নব্য বিএনপি নামধারী অনেকে, যারা কখনো বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অথচ তারাই এখন দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। আর এসব অপকর্মের দায় চাপছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলটির ত্যাগী এবং দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা বিব্রত।
এবার দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, বিএনপি একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন সময় দুষ্কৃতকারীরা বিএনপিতে ঢুকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। যখনই এসব দুষ্কৃতকারীর চেহারা উন্মোচিত হয়েছে তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা বলেন, বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক দল। এ দলে কোনো অপরাধীর জায়গা অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। দলকে ব্যবহার করে কেউ অপকর্ম করতে চাইলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তা কঠোর হাতে দমন করবেন।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই নাই। এ সময় জনগণকে সাথে নিয়ে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারী কিংবা চাঁদাবাজের জায়গা নেই। এদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে দেয়া হবে।
সারা দেশে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২০০১-২০০৬ বিএনপি আমলে সুবিধা নেয়া অনেক ব্যক্তি গত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী মদদপুষ্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। পুরো আওয়ামী আমল তারা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করে এখন আবার বিএনপির ব্যানার-ফেস্টুন ছাপিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ছিলেন মাসুদ রানা। থানা বিএনপির কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে তিনি এখন বিএনপি নেতা। আগামীতে বিএনপির ইউনিয়ন চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবেও প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। এস আলম গ্রুপের সাথে ব্যবসা করা এই নেতা টাকার বিনিময়ে বিএনপিতে ভিড়েছেন বলে দাবি নেতাকর্মীদের।
একই ইউনিয়নে বিএনপির সভাপতি থাকা অবস্থায় জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি হন সিরাজুল ইসলাম। এখন তিনি নিজেকে বিএনপির নেতা দাবি করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সংস্কারপন্থী নেতা অধ্যাপক রেজাউল করিমের অনুসারী হয়ে কাজ করছেন।
একই ইউনিয়নের যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক শহীদ সরকার ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব হিসেবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এখন তিনি থানা বিএনপির অনুসারী হয়ে বিএনপির মিটিং-মিছিলে সরব। সোনারগাঁও উপজেলার সাবেক উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ তপন যোগ দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টিতে। এখন তিনি সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমের অনুসারী হয়ে বিএনপি নেতা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এ দলে কোনো অনুপ্রবেশকারী ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রয়োজন নেই। যারা অপকর্ম করবে তারাই শাস্তি পাবে।
তিনি বলেন, সারা দেশে প্রায় দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনও হয়েছে আমরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তের আগেই বহিষ্কার করেছি। পরে তদন্ত করে নিরপরাধ হলে বহিষ্কার আদেশ তুলে নেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু নয়া দিগন্তকে বলেন, ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিবাদের অনেক দোসর ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোতে অনুপ্রবেশ করে দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দুর্বলতাকে পুঁজি করে লুটপাট করেছে। তাদের এই অপকর্মের দায় বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর ওপরে চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এসব হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। দলের এই কঠোর অবস্থানের কারণে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সবধরনের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তার ফলাফল আপনারা অবশ্যই লক্ষ করেছেন।
কেন্দ্রীয় দফতর সূত্র জানিয়েছে, গত সাত মাসে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের তিন হাজার ২০০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিরই এক হাজার ৮০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এ পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০-এর অধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে। অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, যা সারা দেশে প্রশংসা পেয়েছে। পটপরিবর্তনের পর ১১ আগস্ট দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ স্থগিত করার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়। হেভিওয়েট নেতাদের মধ্যে সর্বশেষ ৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়। সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করে কোথাও দখলবাণিজ্যের কোনোরূপ ঘটনা পরিলক্ষিত হওয়া মাত্রই অপরাধীকে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আটক করে কেন্দ্রীয় দফতরে জানানোর জন্য সচেতন জনসাধারণ ও ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।