নির্বাচন সামনে রেখে ‘ডোর টু ডোর’ ক্যাম্পেইন কর্মসূচিতে নামছে বিএনপি। দলটির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যে নানামুখী প্রোপাগান্ডা চলছে, সেটি আমলে নিয়ে এবং জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রেক্ষিতে এই ধরনের কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে দলটি। এর মধ্য দিয়ে দলটি মূলত নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করতে চায়।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই ধরনের আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চালু এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপাসহ কয়েকটি দল। প্রাথমিকভাবে দলগুলো ঢাকাসহ দেশব্যাপী তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। এরপর নতুন কর্মসূচি দেবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, দলগুলোর এই কর্মসূচি রাজনৈতিক। এটিকে নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের দলীয় দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের একটা কৌশল হিসেবে দেখছে বিএনপি এবং তারাও নিজস্ব কর্মসূচির চিন্তা করছে। জনগণের সম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি নিয়ে তারাও মাঠে নামতে চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করার অধিকার আছে। তারা যদি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কর্মসূচি দেয়, তাদের মাঠের রাজনৈতিক বক্তব্যের জবাব বিএনপি মাঠের বক্তব্যের মাধ্যমেই দেবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, নির্বাচনকে বিএনপিও উৎসবমুখর ও ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হিসেবে দেখতে চায়। এ লক্ষ্যে সরকারকে করা সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে দলটি। এর অংশ হিসেবে বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনী ঢেউ তুলতে চায় দলটি। জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে মানুষের ঘরে ঘরে অর্থাৎ ‘ডোর টু ডোর’ যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন নেতারা। আর এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে দলের মহিলা নেতাকর্মীদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। কেন আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন প্রয়োজন; নির্বাচন বিলম্বিত হলে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগও পিছিয়ে যাবে, যে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তারা দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছে- বিএনপির পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলো তাদের কাছে তুলে ধরা হবে। একইসাথে বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার প্রচারণাও চালানো হবে। বিএনপি আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে এই ৩১ দফার ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সেই প্রতিশ্রুতিও দেয়া হবে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে নির্বাচনমুখী করার পাশাপাশি দলকেও পুরোটাই নির্বাচনমুখী করতে চায় বিএনপি। জানা গেছে, বৈঠকে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিভাবে নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা যায়, সে ব্যাপারে বিএনপি নেতারা আলোচনা করেন। তারা বলেন, নির্ধারিত আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর পাঁচ মাসের মতো বাকি রয়েছে। এমন অবস্থায় দলকে পুরো নির্বাচনমুখী করতে হবে, প্রস্তুত করতে হবে। এ লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে চায় দলটি। ৩১ দফার আলোকে এই ইশতেহার প্রণয়ন নিয়ে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিএনপির পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে প্রতিটি আসনে দলীয় একক প্রার্থী দেয়া হবে। অবশ্য দলের প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন বিক্ষিপ্তভাবে প্রচারণা ও গণসংযোগ চালাচ্ছেন। তবে সবাই যে যার মতো যাতে প্রচারণা চালায়, নিজেদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বে যাতে না জড়ায়, কোনো গ্রুপিং সৃষ্টি না করে, সেজন্য কেন্দ্র থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রতি ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জনগণের পাশে আরো বেশি করে কিভাবে থাকা যায়, সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ইতোমধ্যে জনগণের পাশে থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক-অপকর্মের কারণে দলটির ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে দল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপও নিয়েছে। বিএনপি এখন মনে করছে, এই সাংগঠনিক ব্যবস্থার ফলে সারা দেশে সংগঠনে একটা শৃঙ্খলা এসেছে। বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। তারা সবাই জনগণের পাশে থাকার দলীয় নির্দেশনা মেনে চলছে। বিএনপি আগামীতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়, এ ব্যাপারে দলটির কমিটমেন্ট আছে। জনগণ সেটা যাতে বোঝে, জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়, বিএনপি সেই ধরনের কাজগুলো আগামীতে অব্যাহত রাখবে।
বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত আলোচনার বিষয়াবলি স্থায়ী কমিটিকে অবহিত করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। সনদ বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে দলীয় যে অবস্থান ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তুলে ধরেন, সেটা স্থায়ী কমিটিকে জানান তিনি। সংবিধান সংশোধনের সাথে সম্পর্কিত নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এমন সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করার পক্ষে বিএনপি। সেটা নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে হতে পারে। আর সংবিধানের সাথে সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো নির্বাচিত পরবর্তী সংসদ করবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।