উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় মাউশির ডিজি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তীব্র ক্ষোভ

অব্যাহতি চেয়েছেন অধ্যাপক ড. আজাদ খান

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও ডিজি পদের জন্য কাম্য যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের সব তথ্যই মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এরপরও এভাবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা শুরু হলে নানা ধরনের অবৈধ দেন-দরবার কিংবা তদবিরের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এতে কর্মকর্তা কিংবা সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজনের জন্য বিব্রত হওয়ার মতো পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে। এ দিকে নিজের স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে মাউশির ডিজি পদ থেকে অব্যাহতিপত্র জমা দিয়েছেন অধ্যাপক ড. আজাদ খান। গতকাল মঙ্গলবার সকালে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তিনি নিজেই এই পত্র জমা দেন বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গত সোমবার বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি কলেজ-১ শাখা থেকে উপসচিব তানিয়া ফেরদৌস স্বাক্ষরিত মাউশির ডিজি পদে কাজ করতে আগ্রহী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬তম থেকে তদূর্ধ্ব ব্যাচের কর্মকর্তাদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে অফ লাইনে আবেদন করতে জানানো হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই বিজ্ঞপ্তিতে কয়েকটি শর্ত দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আবেদনকারীকে অবশ্যই ব্যক্তিগত জীবনে সৎ দায়িত্বপরায়ণ এবং প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হতে হবে। একইসাথে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর থাকা আবশ্যক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার সারাদিনই শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে বিষয়টিকে শিক্ষা ক্যাডারের জন্য মর্যাদাহানিকর বলেও মন্তব্য করেন। কেননা এভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মাউশির ডিজি নিয়োগ দেয়া হলে ক্যাডারের মধ্যেই বৈষম্য এবং অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যে শ্রদ্ধাবোধ তা আর থাকবে না। এখানে সবাই সবার প্রতিযোগী হয়ে অংশ নেবেন। দীর্ঘদিনের যে শৃঙ্খলা সেটিরও ব্যত্যয় ঘটবে। শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, অতীতে যেভাবে মাউশির ডিজি নিয়োগ দেয়া হতো এখানেতো কারো কোনো অভিযোগ বা দ্বিমত ছিল না। হয়তো অনেকেই এই পদে আসতে চাইবেন কিন্তু মন্ত্রণালয়ে তো আমাদের সব রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের যোগ্যতা অভিজ্ঞতা কিংবা প্রশাসনিক কাজের দক্ষতার বিষয়েও মন্ত্রণালয় ওয়াকিবহাল। কিন্তু এভাবে আমাদের নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতার যুদ্ধে ঠেলে দেয়া নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৪ বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তার সংখ্যা খুব বেশি নেই। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই অবসরে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে ১৪ ব্যাচের ১০০ কর্মকর্তাও নেই। আবার ১৫তম ব্যাচের মধ্যে কয়েকটি সাবজেক্টে মাত্র ৬০ থেকে ৮০ জন আছেন। আর ১৬ ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তার সংখ্যা তুলনামূলক একটু বেশি। এই সংখ্যাও ৮০০ থেকে ৯০০ এর মধ্যেই হবে। যদিও বিজ্ঞপ্তিতে ১৬ থেকে তদূর্ধ্ব ব্যাচের কর্মকর্তাদের আবেদন করতে বলা হয়েছে। যদিও এভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মাউশির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজি নিয়োগ দেয়া অনেকটা অশোভন কিন্তু মন্ত্রণালয়েরও এর বিকল্প কিছু নেই। কেননা মাউশি এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রতিদিন শত শত তদবির আসছে। সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা একটি অনুষ্ঠানে অনেকটা গোস্বা হয়েই বলেছিলেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদের জন্য তার কাছেই নাকি এক শত কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যেখানে উপদেষ্টার কাছেই শত কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়া হয় সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাউশির ডিজি নিয়োগের এমন প্রতিযোগিতা শুরু হলে এমন অনেক অবৈধ সুযোগের পথ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়। এতে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা পিছিয়ে পড়বেন। এই সুযোগে নানা ফন্দী-ফিকির করে অযোগ্য আর অদক্ষরাই হয়তো চেয়ার দখলে মরিয়া হয়ে উঠবেন। গতকাল সন্ধ্যায় মাউশির ডিজি অধ্যাপক ড. আজাদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমি নিজেও চাই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মাউশিতে আরো দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা আসুক। আমি নিজেও এই পদের জন্য কোনোভাবে লবিং কিংবা কোনো তদবির করিনি। সরকার আমাকে যোগ্য মনে করে এই পদে বসিয়েছে। এখন যদি আরো যোগ্য লোক আসে তাহলে আমি সেটাকেও স্বাগত জানানো। আর আমি এই পদে থাকতে চাইছি না। আজ (গতকাল) সকালে আমি নিজের উদ্যোগেই আমার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এসেছি।

অপর দিকে শিক্ষা ক্যাডারে এখন সবাই চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা হওয়ায় মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) পদটি চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। পদটিতে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি ও ঢাকা কলেজের সাবেক এ অধ্যক্ষ। সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এসব কথা লেখেন তিনি। পোস্টে অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার লিখেছেন, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত দু’টি পদ দ্বিতীয় গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেডে উন্নীত হয়- ১. মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর; ২. মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। ২ নম্বর পদটি অবৈধভাবে বেদখল বহু বছর। তিনি লিখেছেন, স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরও সরকারি হিসেবে সাক্ষরতা হার ৭০ শতাংশ, মানে প্রায় ৬ কোটি লোক এখনো নিরক্ষর।

বিধি অনুযায়ী ক্যাডারের শীর্ষ পর্যায়ের তিনজনের প্রস্তাব সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) হয়ে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার কাছে যাওয়ার কথা, এ তথ্য জানিয়ে অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের একটি বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে কাজ করতে আগ্রহীদের আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে আবেদন চাওয়া হয়েছে। নিশ্চিত কেউ বিদেশে থাকলে মিস্ করবেন। হয়তো প্রভাবশালী কেউ নেই, তাই আবেদন চাওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পজিটিভলি নিচ্ছি। ১৬ বিসিএস ব্যাচ ও ১৪ বিসিএস ব্যাচ আবেদন করার যোগ্য। যেহেতু শিক্ষা ক্যাডারে এখন সবাই চতুর্থ গ্রেড কর্মকর্তা, পদটি চতুর্থ গ্রেডের সবার জন্য ওপেন করে দেয়া উচিত। হয়তো শিগগিরই কেবিনেট সচিব বা শিক্ষা সচিব পদসহ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য শীর্ষ পদের ক্ষেত্রেও এমন বিজ্ঞপ্তি জারি হবে, যাতে যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যায়।