দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি শেষ হয় না নদীর ড্রেজিং

মোংলা বন্দরের ইনার বারে ড্রেজিং প্রকল্প

প্রকল্পের ধীরগতির অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার স্থান নিশ্চিত না করে ড্রেজিং কাজের দরপত্র আহ্বান ও চুক্তি স্বাক্ষর করা। জমি পেতে বিলম্ব হওয়ায় ড্রেজিং কাজ পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

হামিদ সরকার
Printed Edition
নদীতে ড্রেজিং করা হচ্ছে
নদীতে ড্রেজিং করা হচ্ছে |ফাইল ফটো
  • আড়াই বছরের কাজ পৌনে ৫ বছরে মাত্র ৫৮ শতাংশ
  • মেয়াদের সাথে খরচ বেড়েছে ১৯৮.৫৪ কোটি টাকা

দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও মোংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ শেষই হচ্ছে না। যে আড়াই বছরে এই ইনার বারে ড্রেজিং শেষ হওয়ার কথা, সেখানে পৌনে পাঁচ বছরে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে ৫১.০২ শতাংশ। বর্ধিত মেয়াদের বাকি এক বছরে ৪২ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ না হওয়ায় খরচ ১৯৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বেড়েছে। এ দিকে প্রকল্পের ধীরগতির অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার স্থান নিশ্চিত না করে ড্রেজিং কাজের দরপত্র আহ্বান ও চুক্তি স্বাক্ষর করা। জমি পেতে বিলম্ব হওয়ায় ড্রেজিং কাজ পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় জনগণের বাধা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজাইন সংশোধনের কারণেও প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে। আর স্থানীয়রা মনে করেন ড্রেজিং নিয়মিত করতে হবে এবং কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

চলমান প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, মোংলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩১ কিলোমিটার উজানে পশুর নদীর পূর্ব তীরে মোংলা বন্দর অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর থেকে চ্যানেলের প্রবেশমুখ যা আউটার বার নামে এবং জয়মোনিরগোল থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত যা ইনার বার নামে পরিচিত। এ দু’টি এলাকায় প্রায় ৩০ কিলোমিটারব্যাপী চ্যানেলে গভীরতা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মিটার সিডি। চ্যানেলের অবশিষ্ট অংশে গভীরতা ৯ মিটারের অধিক থাকায় শুধু আউটার বার এবং ইনার বারে কম গভীরতার কারণে বন্দরের জেটিতে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত মিটারের অধিক ড্রাফটের জাহাজ আনা সম্ভব হয় না। ফলে কনটেনারাইজড মালামাল আমদানি-রফতানিতে ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত হয় না। আউটার বারে ১১ কিলোমিটারব্যাপী এলাকায় সাড়ে আট মিটার সিডি গভীরতায় ড্রেজিং করার জন্য ‘মোংলা বন্দরের আউটার বারে ড্রেজিং’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ড্রেজিং কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। ফলে স্বাভাবিক জোয়ারে চ্যানেলের জয়মনিরগোল পর্যন্ত সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নির্বিঘেœ আসতে পারলেও হারবাড়িয়া থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত প্রায় ২৩.৪০ কিলোমিটারব্যাপী চ্যানেলের ইনার বারে আউটার বারের মতো সাড়ে আট মিটার সিডি গভীরতায় ড্রেজিং করা হলে মোংলা বন্দরের জেটিতে স্বাভাবিক জোয়ারের সহায়তায় সাড়ে ৯ মিটারের অধিক ড্রাফটের জাহাজ নির্বিঘেœ হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ‘মোংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং’ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।

মোংলা বন্দরের জেটিতে সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিং করার উদ্দেশ্যে ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২০ হতে জুন ২০২২ মেয়াদে আড়াই বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘মোংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং’ প্রকল্পটি গত ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পর্যায়ে ড্রেজিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি, মাটির ডাইক এবং জিওটিউব ডাইকের পরিমাণ বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, আয়কর হার বৃদ্ধি এবং ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার জন্য অতিরিক্ত জমি হুকুমদখলসহ বিভিন্ন কারণে প্রয়োজনীয় অর্থ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৯৯২ কোটি ২৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকায় সংশোধন করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশোধিত প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এরপর ২০২৪ সালের ২ জুলাই নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নের আরো দুই বছর বাড়িয়ে ৩০ জুন ২০২৬ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল সাড়ে ছয় বছরে উন্নীত হয়।

প্রকল্পের প্রধান কাজ : মূল কাজের মধ্যে রয়েছে- ২৩৭.৪৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং, ৩০.৭০ লাখ ঘনমিটার মাটির ডাইক নির্মাণ, এক লাখ ঘনমিটার জিওটিউব ডাইক নির্মাণ।

কাজের অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ : আইএমইডির পর্যবেক্ষক সংস্থা অধুনা বাংলাদেশের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ইনার বারে ড্রেজিং প্রকল্পের হারবাড়িয়া থেকে জেটি সম্মুখ পর্যন্ত ২৩.৪০ কিলোমিটার এলাকায় মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে কাটার সাকশন ড্রেজার দিয়ে বেসক্রিক, মুরিং বয়া ও টার্নিং গ্রাউন্ড এলাকায় ১২১.৮৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ শেষে কনফ্লুয়েন্স এলাকায় ড্রেজিং কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ে ড্রেজিং কাজ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে কাটার সাকশন ড্রেজার দিয়ে সাড়ে ৫৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ বাকি আছে। অন্য দিকে প্রথম পর্যায়ে ড্রেজিং কাজ শেষে ট্রেলিং সাকশন হপার ড্রেজার দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৭.০৭ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ বাকি আছে। এক কথায় প্রকল্পে আনুমোদিত মোট ২৩৭.৫৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের মধ্যে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সর্বমোট ১৩৪.৭৪ লাখ ঘনমিটার অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ড্রেজিং কাজ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে ওই এলাকায় কাটার সাকশন ড্রেজার দিয়ে ৫৫.৫২ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ বাকি আছে। ট্রেলিং সাকশন হপার ড্রেজার দিয়ে ৪৭.০৭ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ বাকি আছে। উল্লেখ্য যে, প্রথম পর্যায়ে যেসব স্থানে কাটার সাকশন ড্রেজার

অন্য দিকে প্রকল্প অনুমোদিত ৩০.৭০ লাখ ঘনমিটার ডাইক (মাটির বাঁধ) এবং এক লাখ ঘনমিটার জিওটিউব ডাইক নির্মাণকাজের মধ্যে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত যথাক্রমে ১৩.৭০ লাখ ঘনমিটার অর্থাৎ ৪৪.৬৩ শতাংশ এবং ০.৯৯ লাখ ঘনমিটার অর্থাৎ প্রায় ১০০ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার জন্য প্রায় এক হাজার ৮৬০ একর নিচু জমি প্রয়োজন হলেও এ পর্যন্ত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মাত্র ৯৬০ একর জমি হুকুমদখল করা সম্ভব হয়েছে। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় ৩০০ একর জমি হুকুমদখল করা হলেও স্থানীয় জনগণের বাধার মুখে ওই জমিতে ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলা সম্ভব হয়নি। বর্তমান অবস্থায় ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার জন্য আরো প্রায় ৯০০ একর জমি হুকুমদখল করা প্রয়োজন, যা না পাওয়া গেলে প্রকল্পের ড্রেজিং কাজ আগামীতে ব্যাহত হতে পারে।

প্রকল্পের ধীরগতির কারণ : ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার স্থান নিশ্চিত না করে ড্রেজিং কাজের দরপত্র আহ্বান এবং চুক্তি করার ফলে চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ঠিকাদার দু’টি ৪০ ইঞ্চি ডিসচার্জ ব্যাসের কাটার সাকশন ড্রেজার এবং একটি সাড়ে পাঁচ হাজার ঘনমিটার ধারণক্ষমতার ট্রেলিং সাকশন হপার ড্রেজার সাইটে এনেছিল। ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া গেলে তিনটি ড্রেজার সমন্বয়ে প্রতিদিন প্রায় ১.১৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা সম্ভব হতো। সে হিসাবে এক বছরের মধ্যেই প্রকল্পের সমুদয় ড্রেজিং কাজ সমাপ্ত হয়ে যেত। দ্রুত ড্রেজিং কাজ শেষ হওয়ায় পলি জমার হারও কম হতো; কিন্তু জমি পেতে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পের ড্রেজিং কাজ পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হওয়া প্রকল্পের একটি প্রধান দুর্বল দিক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ধীরগতির মূল কারণ হলো, ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার পর্যাপ্ত জমি না পাওয়া, জমির হুকুমদখল প্রক্রিয়ায় অধিক সময় ব্যয় হওয়া। এ ছাড়া খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় ৩০০ একর জমি হুকুমদখল হওয়ার পরও জনগণের বাধার কারণে কাজ করতে না পারায় প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে।

মোংলা বন্দর নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য : প্রকল্প সম্পর্কে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান পর্যবেক্ষক সংস্থাকে বলেন, এই বন্দর এলাকায় তিনি ৯ বছর যাবৎ কাজ করছেন। এই প্রকল্প সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অবগত। প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ জুন ২০২৬-এর মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। সর্বোচ্চ গুণগত মান বজায় রেখে কাজটি করা হচ্ছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হবে। তবে নিয়মিত সংরক্ষণ ও ড্রেজিং করতে হবে।

প্রকল্পের মিটিগেশন প্ল্যান বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ফিজিবিলিটি স্টাডিতে বর্ণিত এনভায়রনমেন্ট মিটিগেশন প্ল্যান অনুযায়ী করা হচ্ছে। প্রকল্পের মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করেছে। প্রকল্পটি টেকসই হবে কি না এ সম্পর্কে তিনি বলেন, পশুর নদীতে সিল্টেশনের হার অত্যধিক। কাজেই প্রকল্পটি টেকসই হবে কি না বলা কষ্টসাধ্য। তিনি বলেন, কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা হলো ড্রেজিং এর মাটি ফেলার জমির অপ্রতুলতা। এ জন্য ড্রেজিং টেকসই করার জন্য নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিং নদী শাসন করা প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো ড্রেজিংয়ের মটি ফেলার জমি না পাওয়া। এটির সমাধানের জন্য তিনি ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন।

অন্য দিকে প্রকল্পের ব্যাপারে আইএমইডির পর্যবেক্ষক সংস্থা অধুনা বাংলাদেশ বলছে, প্রকল্পের অর্থবছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কোনো বছরেই বাস্তব অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের জন্য বছরভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ, অর্থ ছাড় ইত্যাদি সন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদার নির্বাচন, ভরাট এলাকার নিচু জমি হুকুমদখলে বিলম্ব, ডাম্পিং কম্পার্টমেন্টের আকার ছোট হওয়ার কারণে ড্রেজিং কাজটি পরিকল্পনামাফিক করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও ড্রেজিংকালীন পুনঃভরাটের হার অত্যাধিক বেশি হওয়ায় প্রত্যাশা মতো অগ্রগতি করা সম্ভব হয়নি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। প্রকল্পের সম্ভাবতা যাচাই সমীক্ষায় পুনঃভরাটের হার এবং ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার ব্যবস্থাপনা (জমির প্রাপ্ততা) বিষয়ে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা না থাকায় চ্যানেলের ডিজাইন (গভীরতা এবং প্রস্থ) পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা বর্ধনের প্রয়োজন হয়েছে। সঠিকভাবে সমীক্ষা করে প্রকল্প হাতে নিলে এই অসুবিধাগুলো পরিহার করার সুযোগ ছিল।