জীবননগরে ৫ কোটি টাকার পানি শোধনাগার অচল হয়ে পড়ে আছে

অব্যবস্থাপনার কারণে নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত পৌরবাসী

আতিয়ার রহমান, জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা)
Printed Edition
জীবননগরে ৫ কোটি টাকার পানি শোধনাগার অচল হয়ে পড়ে আছে
জীবননগরে ৫ কোটি টাকার পানি শোধনাগার অচল হয়ে পড়ে আছে

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর পৌরসভার প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভূগর্ভের পানি শোধনাগারটি নির্মাণের পাঁচ বছর পরও অচল পড়ে আছে। ২০২১ সালে সরকারি প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হলেও চলতি বছরে এক দিনও শোধনাগারটি চালু করা হয়নি। এতে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন পৌর এলাকার অন্তত পাঁচ হাজার বাসিন্দা।

সরেজমিন দেখা যায়, দীর্ঘ অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরো স্থাপনাটি পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত ভবনে। শোধনাগারের পাম্প হাউজ, ওভারহেড ট্যাংক ও রিজার্ভ ট্যাংকের চার পাশ জঙ্গলাকীর্ণ। বহু যন্ত্রাংশ- মোটর, ফিল্টার, সুইচবোর্ড, জেনারেটর, পাইপ ও ট্রান্সফরমার চুরি বা নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনগুলোর দরজা-জানালা ভাঙা, দেয়ালে ফাটল; মূল কন্ট্রোল রুমে নেই প্রয়োজনীয় মেশিনারি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরুর সময় থেকেই প্রকল্পটিতে ছিল ‘অনিয়ম ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের’ ছায়া। তৎকালীন মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রভাব এবং অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনির ট্রেডার্স প্রকল্পের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। অভিযোগ অনুসারে মেয়রের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দিয়ে নির্মাণকাজ করানো হয়েছিল, যার কারণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও ত্রুটিপূর্ণ কাজের নজির সৃষ্টি হয়। সে সময় কেউ প্রতিবাদ করতেও সাহস পায়নি।

‘পৌরসভা থানা গ্রোথ সেন্টার’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর শোধনাগারের কাজ শুরু করে এবং ২০২১ সালে সমাপ্ত ঘোষণা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আধুনিক শোধনাগার, পাম্প হাউজ, ওভারহেড ট্যাংক, রিজার্ভ ট্যাংক ও প্রথম দফায় ৩০০টি সংযোগ স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে পৌরসভা আরো ২০০ সংযোগ যোগ করে। দৈনিক তিন হাজার ৫০০ ঘনমিটার পানি সরবরাহের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পটি কখনো চালু হয়নি।

পৌরসভা কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রকল্পটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি, তাই তারা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারছেন না। কিন্তু জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজিব হাসান রাজু বলেন, নিয়ম মেনে কাজ সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়। পৌরসভা পাল্টা দাবি করেছে, তাদের নথিতে কোনো হস্তান্তর সংক্রান্ত কাগজ নেই।

এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘নথি গায়েব’ এবং ‘দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতা’ এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, নির্মাণকাজে প্রকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে রুপা কনস্ট্রাকশনসহ কিছু প্রভাবশালী ঠিকাদার জোট প্রকল্পটি দখল করে নেয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী রাজিব রাজুর বিরুদ্ধে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে, যার অনুসন্ধান দুদক করছে।

জীবননগর পৌর প্রশাসক সৈয়দজাদী মাহবুবা মঞ্জুর মৌনা জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি প্রকল্পটির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন; কিন্তু বারবার নথি চাইলেও কেউ কোনো নথি দেননি। তার ভাষায়, ‘কোটির টাকার প্রকল্প এভাবে অচল হয়ে পড়ে আছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ বিষয়টি তিনি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। অপর দিকে পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, দক্ষ অপারেটর ও টেকনিক্যাল জনবল না থাকায় সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন, যে প্রকল্প চালু হওয়ার আগেই যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়, সেটি কতটা মানসম্মত ছিল? প্রকল্পটি কয়েক মাস ট্রায়াল রান করে পৌরসভাকে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এখন পুরো স্থাপনাটি ভেঙেচুরে সুইপারদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।

পৌরবাসীর দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- অচল শোধনাগারে চুরি হওয়া বা নষ্ট যন্ত্রাংশ পুনঃস্থাপন, প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত, দ্রুত শোধনাগার চালু করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, ভবিষ্যতে সরকারি অর্থ অপচয় ও অনিয়ম রোধ।

মাত্র পাঁচ বছরেই নষ্ট হয়ে যাওয়া এই পানি শোধনাগার প্রকল্প জীবননগরে সরকারি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার এক করুণ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির জটিলতায় পাঁচ কোটি টাকার অবকাঠামো এখন অচল, আর পৌরবাসী বিশুদ্ধ পানির মতো মৌলিক সেবা থেকেও বঞ্চিত। এখন প্রশ্ন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কবে জবাবদিহির আওতায় আসবে এবং কবে নাগরিকরা পাবেন তাদের ন্যায্য সেবা?