নূরুল ইসলাম মনি
রোশান তার মাকে বলল,‘মা আমি দুধচিতই খাবো।’ রোশানের মা বলল, ‘ঠিক আছে খাবি। কোনো অসুবিধা নেই। বানিয়ে দিবোনে।’
‘কোন দিন বানাবা?’
‘ধান কাটলে বানাব। আর কয়দিন সবুর কর। ধান কাটলেই দুধচিতই বানিয়ে দেবো।’
‘ধান কাটতে হবে কেনো মা? আমাদের ঘরে তো অনেক ধান আছে।’
‘ওগুলি তো পুরনো ধান। গত বছরের ধান। ওগুলো দিয়ে পিঠা বানালে পিঠা হবে ঠিকই, কিন্তু বেশি মজা হবে না। নতুন ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা বানালে, সেই পিঠা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় হবে।’
‘আমাদের ধান কোন দিন কাটবে মা?’
‘কাটবে তো। পাকলেই কাটবে।’
‘এখনো পাকে নাই?’
‘কিছু পেকেছে। আর কিছু বাকি আছে। আর দুই-এক দিন লাগবে বোধ হয়। তার পরেই কাটা শুরু হবে।’
‘আমি আজকে ক্ষেতে গিয়ে দেখে আসব ধান কতদূর পেকেছে।’
‘না না না। তোকে যেতে হবে না। তোর বাপ প্রতিদিন গিয়ে দেখে আসে। তাতেই চলবে। রোদের মধ্যে তোর যাওয়ার দরকার নেই।’
‘তাছাড়া তুই তো ধানের ক্ষেতগুলো চিনিসই না। কেমনে যাবি। তোর বাপের তো অনেক ধানক্ষেত। একটা দুইটা হলে না হয় চিনতি।’
দু’দিন পরেই রোশানের আব্বা ধান কাটার জন্য দশজন কামলা ডেকে আনল।
তারা প্রতিদিন ধান কাটে আর সেগুলোকে আঁটি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে।
এইভাবে আনতে আনতে কয়েক দিনের মধ্যেই অনেক ধান বাড়িতে এসে গেল।
রোশান তার মাকে বলল, ‘মা এখন তো নতুন ধান বাড়িতে এসেছে। এখন পিঠার ব্যবস্থা করো।’
‘নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করব বাবা। তুই কোনো চিন্তা করিস না’।
‘এবার কিন্তু খুব বেশি পরিমাণ পিঠা বানাতে হবে’।
মা বলল, ‘কেন? খুব বেশি পরিমাণ কেন? বাজারে নিয়ে বিক্রি করবি নাকি?’
‘না, ঠিক তা না। আমার ক্লাসের সব পোলাপানকে আমি দাওয়াত করব তো, তাই বলছি আর কি’।
‘তারা কার কাছে যেন শুনেছে তুমি খুব ভালো পিঠা বানাও। সেই কথা শুনে পিঠা খেতে বায়না ধরেছে’।
‘তোর ক্লাসের পোলাপান কতজন হবে’?
‘চল্লিশ জন আম্মু। আমার ক্লাসে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা চল্লিশ জন।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। চল্লিশ জন। কোনো অসুবিধা নেই। আমি আগে পিঠার জিনিসপত্র রেডি করি। তারপর একদিন তাদেরকে দাওয়াত দিস।’
চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই রোশানের মায়ের পিঠার প্রস্তুতি অর্থাৎ উপকরণ সংগ্রহ শেষ হয়ে গেল। নতুন ধান ভেঙে চাল তৈরি করা, চাল থেকে পিঠার গুঁড়া তৈরি করা, গাছ থেকে নারিকেল পাড়া, দোকান থেকে চিনি আর খেজুরের গুড় কিনে আনা এসব কাজ চার পাঁচ দিনের মধ্যেই হয়ে গেলো।
রোশান এবার তার ক্লাসের বন্ধুদেরকে পিঠা খাওয়ার জন্য দাওয়াত করল। তার ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী হলো তার দাওয়াতপ্রাপ্ত মেহমান।
দাওয়াতের নির্দিষ্ট দিনের আগের রাতে রোশানের মা গুণে গুণে ২০০ পিস চিতই পিঠা, ২০০ পিস পোয়া পিঠা, আর ২০০ পিস পাটিসাপটা পিঠা তৈরি করল। তাছাড়া এক হাঁড়ি নারিকেলের পিঠা এক হাঁড়ি কড়ি পিঠাও তৈরি করল রোশানের মা।
এরপর এক কড়াই দুধে পরিমাণ মতো চিনি, দারুচিনি, এলাচি এবং আরো কী কী জিনিসপত্র মিশিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে সিরা তৈরি করা হলো।
এবার এই সিরার মধ্যে সব চিতই পিঠা ডুবিয়ে রাখা হলো। অন্য জাতের পিঠাগুলো পরিষ্কার নতুন হাঁড়িতে ভরে যতেœর সাথে রেখে দেয়া হলো।
এসব কাজে রোশান এবং আরো দু’জন কাজের মেয়ে প্রায় রাতভর রোশানের মাকে সহযোগিতা করল।
পরের দিন সকাল বেলা। রোশানের কাছে মনে হচ্ছে আজ ঈদের দিন। সে আর তার পিচ্চি বোন রিশা দু’জনে নতুন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে তৈরি হয়ে মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।
আগে থেকেই কথাছিল যে, নিমন্ত্রিত পোলাপানগুলো তাদের স্কুলের সামনে এসে জড়ো হবে এবং সেখান থেকে রোশানের আব্বু তাদের সবাইকে একসাথে পথ দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসবে। রোশানদের বাড়ি স্কুল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। কাজেই আসতে কোনো গাড়ির দরকার হবে না।
কিছুক্ষণ পরে রোশানের আব্বা তাদের সবাইকে বাড়িতে নিয়ে এলো।
কলরব করতে করতে তারা এলো। আসার পরে তাদের সবাইকে দুধচিতই খেতে দেয়া হলো। সবাই মিলেমিশে হই-হুল্লোড় করে পিঠা খেতে থাকল। পোলাপানের হাসিখুশি আর আনন্দ উল্লাস দেখে রোশানের মা বাবারও খুব ভালো লাগল। তাদের মনে হলো, শুধু রোশান রিশা একাই তাদের সন্তান নয় বরং উপস্থিত সব শিশুই তাদের সন্তান। এই শিশুগুলোকে খুশি হতে দেখে তাদের মনটাও আনন্দে ভরে উঠল।


