ফের আগুনে পোড়ানোর রাজনীতি

ঢাকায় ককটেল বিস্ফোরণ অগ্নিসংযোগে আতঙ্ক ও প্রশ্ন

বাসে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ এবং সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ - এসব ঘটনার পেছনে কে বা কারা আছেন, উদ্দেশ্য কী এবং এ চক্র ভাঙার উপায় কী - এসব প্রশ্ন এখন সর্বত্র। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অনিবার্যভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ তৈরি করাই মূল লক্ষ্য হতে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
ফের আগুনে পোড়ানোর রাজনীতি
ফের আগুনে পোড়ানোর রাজনীতি

গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে গণপরিবহন ও বিভিন্ন স্থানে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা সাধারণ মানুষকে স্বস্তিহীন করেছে। বাসে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ এবং সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ - এসব ঘটনার পেছনে কে বা কারা আছেন, উদ্দেশ্য কী এবং এ চক্র ভাঙার উপায় কী - এসব প্রশ্ন এখন সর্বত্র। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অনিবার্যভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ তৈরি করাই মূল লক্ষ্য হতে পারে। তবে নির্ধারিত অভিযোগ ছুড়ে দেয়ার বদলে স্বচ্ছ, ফরেনসিক ও শিগগির তদন্ত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।

রাজধানীর ঘটনা

গত কয়েক দিনে রাজধানীর রমনা, উত্তরা, মিরপুর, সূত্রাপুর, আগারগাঁও ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পৃথকভাবে বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনার মধ্যে অন্যতম :

- মোহাম্মদপুর- প্রিপারেটরি স্কুলে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ : ইকবাল রোডের প্রতিষ্ঠানটির গেটে দুইটি পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। রাতের সিসিটিভি ফুটেজে দুটি মোটরসাইকেলে করে আসা চারজনকে দেখা যায়; তারা মুখ ঢাকা ও হেলমেট পরিহিত ছিল। হতাহত হয়নি, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে।

- মোহাম্মদপুর- ককটেলসহ গ্রেফতার : ঢাকা উদ্যান থেকে মো: আবদুর রহমান (৪৫) নামে একজনকে দু’টি ককটেলসহ আটক করেছে পুলিশ। তিনি ভোলার এক ইউনিয়নের মেম্বার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে পুলিশের প্রাথমিক দাবি।

- আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন এলাকা থেকে ককটেল সদৃশ বস্তু উদ্ধার : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কমপাউন্ডে স্কচটেপে মোড়া চারটি ককটেল-সদৃশ বস্তু পাওয়া যায়; সকালেই বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে।

- মিরপুর শতাব্দী পরিবহনের বাসে অগ্নিসংযোগ : সানি সিনেমা হলের সামনে শতাব্দী পরিবহনের একটি বাসে মোটরসাইকেল থেকে আগুন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

- উত্তরা মাইক্রোবাসে আগুন : জসীমউদ্দীন রোড এলাকায় একটি হায়েস মাইক্রোবাস অগ্নিদগ্ধ হয়েছে; ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণ করে বলেছে ইঞ্জিন ওভারহিট থেকে আগুন লাগতে পারে।

- রমনা থানা গ্রাউন্ড পুলিশের গাড়িতে আগুন : গাড়ির মেরামতের সময় ব্যাটারি সংযোগ থেকে আগুন লেগেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে; এ ঘটনায় কাউকেই দোষারোপ করা হয়নি।

- ধোলাইপাড় ও অন্যান্য স্থান : ধোলাইপাড়ে বাসে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে কাজ করেছে; হতাহত হওয়ার খবর মেলেনি।

এ ছাড়া গাজীপুরের তিন স্থানে ও আশুলিয়ায় রাতের বেলায় দাঁড় করিয়ে রাখা বাসে আগুন দেয়া হয়।

কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে- বিশ্লেষকদের ধারণা

বিশ্লেষকরা বিচার করে দেখান যে এ ধরনের সহিংসতা সাধারণত তিনটি উদ্দেশ্যই বহন করতে পারে :

১. ভীতি ও অস্থিরতা সৃষ্টি : জনজীবন ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত করে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরির মাধ্যমে রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করা।

২. প্রতিপক্ষকে পিছিয়ে দেয়া : নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি (মিছিল, সমাবেশ, নির্বাচন ইত্যাদি) কে বিঘিœত করা- কখনো কখনো পরিকল্পিতভাবে সময়সূচি ভাঙানোর উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয়।

৩. বহিরাগত বা অপরাধী উপাদানের সুযোগ : সাইবার-মিথ প্রচারণা, তৃণমূল উসকানিদাতা বা প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাধ গোষ্ঠী পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে নিজেদের সুবিধা নিতে পারে।

তবে, এসব অনুমান- স্বচ্ছ তদন্ত ও ফরেনসিক প্রমাণ ছাড়া- কেবল অনুমানই থেকে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজবও পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলে।

ক্ষতি ভোগ করছে- সবার আগে সাধারণ জনগণ : এই সহিংসতার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ যাত্রী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা। গণপরিবহন আঘাতপ্রাপ্ত হলে দৈনন্দিন চলাচল ব্যাহত হয়, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্কুল-কলেজের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগযোগ্যতা কমে-এরও দীর্ঘমেয়াদি মূল্য চুকাতে হতে পারে।

রাজনীতি না, আইনশৃঙ্খলা- বাস্তবতা স্পষ্ট : রাজনৈতিক লক্ষ্য নিশ্চিত করতে সহিংসতা কার্যকর নয় বরং এটি জনগণের সহমর্মিতা ও সমর্থন হারিয়ে দেয়। বাস্তবে পরিবর্তনের পথ হলে তা গণসংলাপ, আইনি লড়াই ও জনমত গঠনের মাধ্যমে হতে হবে, ভয়ের মাধ্যমে নয়। যেকোনো কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল জনগণকে পাশে নিয়ে সুনির্দিষ্ট, প্রতিষ্ঠিত এবং আইনি পথ অবলম্বন করবে।

৫টি জরুরি পদক্ষেপের প্রস্তাব : বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পাঁচটি পদক্ষেপ অবিলম্বে নেয়া হলে তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে :

১. স্বচ্ছ, তাৎক্ষণিক ও ফরেনসিক তদন্ত : প্রতিটি ঘটনার অপরাধ-তদন্ত ও ফরেনসিক মূল্যায়ন দ্রুত ও স্বাধীনভাবে চালানো; ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।

২. স্থানীয় গোয়েন্দা-সহযোগিতা ও সাইবার মনিটরিং : কমিউনিটি-স্তরের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব শনাক্তে সক্রিয় সাইবার মনিটরিং প্রয়োজন।

৩. রাজনৈতিক পক্ষ-মীমাংসা ও ডি-এস্কালেশন মেকানিজম : রাজনৈতিক নেতৃত্বদের মধ্যে তাৎক্ষণিক পোস্ট, প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি মধ্যস্থতায় ‘ডি-এস্কালেশন’ চুক্তি জরুরি।

৪. জনসচেতনতা ও মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা : গুজব রোধে সুশৃঙ্খল তথ্যপ্রচারের উদ্যোগ, বিজ্ঞপ্তি ও রিউমার কন্ট্রোল ব্যবস্থার কৌশল প্রয়োগ এবং মিডিয়ার দায়বদ্ধতা জোরদার করা।

৫. আইনিব্যবস্থা ও প্রতিশ্রুতিমূলক শাস্তি : প্রমাণিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও শাস্তিযোগ্য আইনিব্যবস্থা গ্রহণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে, তারই মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ সম্ভব।

সংলাপে স্থায়ী সমাধান : বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- রাজনীতির লক্ষ্য যদি সত্যিকারের পরিবর্তন, ন্যায়বিচার ও জনগণের কল্যাণ হয়- তাহলে সহিংসতার পথে চলা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আবারো আগুনে পোড়ানোর রাজনীতি’ দীর্ঘমেয়াদে কোনো অর্জন দিতে পারে না; এর ফল যে কেউ ভোগ করবে সেটি স্পষ্ট- সর্বপ্রথমেই সাধারণ মানুষ। এখন প্রয়োজন দ্রুত, স্বচ্ছ তদন্ত, রাজনৈতিক সংলাপ এবং সমাজকে নিরাপদ রেখে মতভেদ মীমাংসার বাস্তব পদক্ষেপ। দেরি করলে ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বেড়ে যাবে- এবং যা অর্জিত হবে তা মাত্র অস্থায়ীই থাকবে।