সিস্টেম লস কমানোর প্রকল্পই সিস্টেম লসে

সাড়ে ২৯ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ।

হামিদ সরকার
Printed Edition

সিস্টেম লস কমানোর প্রকল্পটি এখন সিস্টেম লসের কবলে। কেনা হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতায় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি বিদ্যুতের ২৪.৮৭ শতাংশ বা দুই লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার। সাড়ে ২৯ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। এক শতাংশ নন-টেকনিক্যাল সিস্টেম হ্রাস হাস, বিদ্যুতের রাজস্বের ১০০ শতাংশ অগ্রিম সংগ্রহের লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেয়া হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি প্রকল্প পরিদর্শন থেকে বলছে, স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার সংগ্রহে বিলম্ব, জনগণের মাঝে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও নেতিবাচক মনোভাব, বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মিটার স্থাপনের কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। ডিপিপিতে সংস্থান থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কোনো প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি। প্রকল্প পরিচালক বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির ডিপিপি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। একনেকে শিগগরিই অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করার হবে। তাতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ও ব্যয় ৭৭০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়বে।

বিদ্যুৎ, শক্তি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিপিডিবির চলমান প্রকল্পের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) বিশাল বকেয়া এবং বেশ কিছু এসঅ্যান্ডডিএস বা ইএসইউএস’র অধিক পরিমাণে নন-টেকনিক্যাল লসের কারণে বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রচলিত অ্যানালগ মিটারিং সিস্টেম উক্ত নন-টেকনিক্যাল ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ। অন্য দিকে, বিদ্যমান পোস্টপেইড বিলিং সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। আবার, এই বিলিং পদ্ধতিতে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের দুই বা তিন মাস পর রাজস্ব আদায় করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া, অ্যানালগ মিটারিং সিস্টেমে অনুমোদিত লোডের তুলনায় অতিরিক্ত লোড ব্যবহারের প্রবণতা এবং মিটার টেম্পারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং বিদ্যমান সিস্টেমের ক্ষতি ও রাজস্ব ক্ষতি রোধে, বিপিডিবি কর্তৃক চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জে পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রি-পেমেন্ট মিটারিং ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পাইলট প্রকল্পগুলোর সাফল্যের পর, বিভিন্ন মিটার প্রস্তুতকারককে একটি একক সিস্টেমে একীভূত করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিপিডিবি ইউনিফাইড প্রি-পেমেন্ট ই-মিটারিং সিস্টেম বাস্তবায়ন করে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিপিডিবি’র চারটি জোনে প্রায় ১২ লাখ প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন করে। মার্চ ২০২১ এর মধ্যে সিস্টেমে আরো ১২ লাখ প্রি-পেমেন্ট মিটার সংযুক্ত হয়েছে, যেগুলো সচল রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিপিডিবি ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং অনুরোধ করে, যা দিয়ে তার চারটি বিতরণ অঞ্চলে ১০ লাখ ২০ হাজারটি সিঙ্গেল-ফেজ এবং ৩০ হাজারটি থ্রি-ফেজ প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন করবে।

ফলে গত ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি’ প্রকল্পটি ৬১৯ কোটি ৩০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০২২ সালের মার্চ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছরে বাস্তবায়ন করার জন্য অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়ন হলো ৩২৮ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, বাংলাদেশ সরকারের ১৬৯ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব ১২০ কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। দেশের চার বিভাগের ১৩ জেলার ১৯টি উপজেলা বা সিটি করপোরেশনে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

লক্ষ্য সিস্টেম লস ১ শতাংশ হ্রাস

এক শতাংশ নন-টেকনিক্যাল সিস্টেম লস হ্রাস, বিদ্যুতের রাজস্বের ১০০ শতাংশ অগ্রিম সংগ্রহ করা এবং গ্রাহককে দ্রুত এবং ঝামেলাবিহীন পরিষেবা প্রদান। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চারটি ডিস্ট্রিবিউশন জোনে ১০ লাখ ২০ হাজার সিঙ্গেল-ফেজ এবং ৩০ হাজার থ্রি-ফেজ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবি’র সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জোনে সিস্টেম লস কমেছে। সার্বিকভাবে কমে ৬.৯৯ শতাংশ। আর ওই তিন জোনের মধ্যে সিলেটে ৮.২১ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ৬.৪৩ শতাংশ।

মেয়াদে কাজের অগ্রগতি ৭০.৫ শতাংশ

বিপিডিবি’র তথ্য বলছে, প্রকল্পটি তিন বছরে সমাপ্ত করার জন্য অনুমোদিত হয়। ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ছিল প্রকল্পটির তিন বছর মেয়াদ। আর ওই সময় পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি সাড়ে ৭০ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি ৭০.৩৭ শতাংশ।

আইএমইডি’র পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টস (আইটিএমসি) তথ্য বলছে, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ছিল মোট সাড়ে ১০ লাখ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার সংগ্রহ ও স্থাপন করা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে তিন বছরে সাত লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৩ টি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার (সিঙ্গেল ফেজ ও থ্রি-ফেজ) সংগ্রহ করা হয়। চার লাখ ৭৬ হাজার ২০৮টি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার (সিঙ্গেল ফেজ ও থ্রি-ফেজ) স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি, দুইটি কার্যক্রম (তিন বছরের অপারেশনাল সাপোর্ট সার্ভিস এবং প্রশিক্ষণ)-এর অগ্রগতি শূন্য। কেননা প্রকল্পের আওতায় সব স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপনের পর এই কার্যক্রমগুলো শুরু করা হবে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পের মাধ্যমে সংগৃহীত দুই লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। গ্রাহকদের মাঝে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারের ব্যবহারের সুবিধা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রচার ও প্রচারণা করা হলে অস্থাপিত মিটারগুলো স্থাপন করার সম্ভাবনা ছিল। স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন পরবর্তী তিন বছর পর থেকে এসঅ্যান্ডডি বা ইএসইউ’র মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা হবে। সে জন্য উক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজে জড়িত ব্যক্তিদের (নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ইলেকট্রিশিয়ান বা লাইনম্যান, হেলপার) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রশিক্ষণের সংস্থান থাকলেও তা প্রকল্প মেয়াদকালে বাস্তবায়ন করা হয়নি। পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টস (আইটিএমসি) বলছে, প্রকল্পের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত থাকলেও প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পূর্ণ হয়নি। আবার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য প্রথম সংশোধিত ডিপিপি নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা চলাকালীন পর্যন্ত অনুমোদিত হয়নি। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কার্যক্রমে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

সংগৃহীত ২৪.৮৭ শতাংশ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার (সিঙ্গেল ফেজ ও থ্রি-ফেজ) স্থাপনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে অতি দ্রুত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। গুরুত্ব বিবেচনায় জিডি-১ ক্রয় প্যাকেজের ব্যাচ-৪ এর এক লাখ ৭ হাজার ৫৭৪টি সিঙ্গেল ফেজ মিটার দ্রুত সংগ্রহ করে স্থাপন করতে হবে। এক্সিট প্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য এনঅ্যান্ডডি বা ইএসইউ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারের লাইফ টাইম (১০ বছর) পরবর্তী ব্যবস্থাপনা (নষ্ট মিটার অপসারণ, সংরক্ষণ ও নতুন মিটার প্রতিস্থাপন ইত্যাদি) সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

প্রকল্পটির ব্যাপারে মুঠোফোনে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও বিপিডিবি’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোজহারুল ইসলাম গতকাল দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগামী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত হবে। ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ সমাপ্ত হবে। তিনি বলেন, ব্যয় বাড়বে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে ৭৭০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, আট লাখ ২১ হাজার মিটার আমরা চুক্তি করেছি। এর মধ্যে সাত লাখ ১৪ হাজার মিটার ইতোমধ্যে চলে এসেছে। পাঁচ লাখ ১৬ হাজার মিটার স্থাপন করা হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন হলে আমরা এক লাখ সাত হাজার মিটার আমরা আনতে পারবো।