আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সাতটি অঙ্গীকারে স্বাক্ষরের আহ্বান জানানো হয়েছে। সনদে বলা হয়েছে, সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়া অনুযায়ী, এই সনদ শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়, বরং এটি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান, আত্মত্যাগ ও জনচেতনার প্রতিফলন এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জন্মের রূপরেখা।
আন্দোলনের রক্তাক্ত পটভূমি : প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় জনগণের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানে। এতে অন্তত এক হাজার ৪০০ নিরস্ত্র নাগরিক নিহত হন, আহত হন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। দীর্ঘ একচ্ছত্র ক্ষমতা, দলীয়করণ, নিপীড়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই অভ্যুত্থান ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটায়।
এই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতির নির্দেশে ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শাসনব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
সংস্কার কমিশন ও তাদের প্রতিবেদন : ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর সরকার ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেগুলো হলো : সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।
এই কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের সুপারিশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জমা দেয়।
জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদ : ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার কাজ ছিল সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানো।
কমিশন ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সাথে মোট ৪৪টি বৈঠক করে। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার সুপারিশের সারাংশ এনে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে একটি ঐকমত্য দলিল প্রণয়ন করা হয়।
সাতটি মূল অঙ্গীকার : সনদের খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিচের সাতটি অঙ্গীকারে স্বাক্ষরের আহ্বান জানানো হয়েছে : সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, যা আত্মত্যাগের প্রতীক ও গণআকাক্সক্ষার ফসল। সাংবিধানিক ও আইনি পরিবর্তন আনা, যেমন- প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন। দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করা। প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারকে সংবিধানসম্মত ভিত্তি দেয়া। ২০২৪ সালের আন্দোলনের সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেয়া। সব দলের আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
১৬৬টি সুপারিশ বিশ্লেষণ : কমিশনের পাঠানো স্প্রেডশিট অনুযায়ী ৩৮টি দল ও জোটের কাছে পাঠানো হয় গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ। এর মধ্যে ছিল : সংবিধান সংস্কার : ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা : ২৭টি, বিচার বিভাগ : ২৩টি, জনপ্রশাসন : ২৬টি. দুর্নীতি দমন : ২০টি। পুলিশ সংস্কার : আলাদা প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়নের পর্যায়ে ৩৫টি দল লিখিত মতামত প্রদান করে, যার মধ্যে অনেকে বিশ্লেষণসহ সুপারিশ দেয়।
ঐতিহাসিক রূপরেখা : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানায়, এই সনদ বাস্তবায়নই হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের মূলধারায় ফেরা। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত চেতনা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, আবার ফিরিয়ে আনার পথচিত্র। একই সাথে ২০২৪ সালের শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ।
সনদে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ কমিশনের সব সদস্যের স্বাক্ষরও থাকবে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ : বিশ্লেষকদের মতে, এ সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সময়সীমার প্রতি শ্রদ্ধা, এবং নাগরিক সমাজের শক্তিশালী নজরদারি অপরিহার্য। ব্যর্থতা হলে জনআকাক্সক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে; সাফল্য এলে এটি হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট।