ফররুখ আহমদের মৃত্যু ও সমকাল

Printed Edition
ফররুখ আহমদের মৃত্যু ও সমকাল
ফররুখ আহমদের মৃত্যু ও সমকাল

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ

জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন অনমনীয় ও নিরাপস আদর্শবাদী, তোষামোদবিমুখ, সত্যবাদী, স্পষ্টবাদী, নির্লোভ, অবৈষয়িক, উদার, অতিথিবৎসল, আত্মপ্রত্যয়ী ও আনন্দময়। -আবদুল মান্নান সৈয়দ

তার জীবন ছিল সরল, একরৈখিক ও সত্যের ওপর সমাসীন। তার কর্মজীবন, সাহিত্যিক জীবন ও জান্নাতের পথে অনন্তযাত্রা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

কবি ফররুখ বলেছিলেন : ‘মুমিনের মৃত্যুই চেয়েছি/ দীর্ঘ দিন এ জীবনে- আল্লাহ্র দরগাহে। অসত্যের/ অন্যায়ের পদপ্রান্তে চাই নাই আত্মসমর্পণ/ পৃথিবীতে।’ -নৌফেল ও হাতেম

এই সত্যনিষ্ঠ কবির মহাপ্রয়াণে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বল্প পরিসরের গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ ও সমবেদনার ঝড় উঠেছিল। সে সময়ের বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন কবির মৃত্যুসংবাদ বারবার প্রচার করেছিল। বিশেষত বাংলাদেশ বেতারে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাকে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করেন। তার বিখ্যাত কবিতাসমূহ স্মরণানুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হয়।

সে সময়ে প্রকাশিত প্রতিটি সংবাদপত্রে তার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ পায়। দৈনিক আজাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদ, দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক, The Bangladesh Observer, সাপ্তাহিক চিত্রালী, ঢাকা ডাইজেস্ট, মাসিক মদীনা প্রভৃতি পত্রিকায় কবি ফররুখের গৌরবোজ্জ্বল জীবন ও কর্মের ওপর সম্পাদকীয়-উপ-সম্পাদকীয়, ফিচার প্রকাশিত হয়। তাতে ফুটে ওঠে তার সংগ্রামী জীবনের নানা দিক। এখানে সংক্ষেপে তার দু-একটি উল্লেখ করছি : অকস্মাৎ শরতের সুনীল আকাশের বুক চিরে বজ্রপাত হলো। আমরা জানলাম বাংলার কাব্যাঙ্গন থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপটি নিভে গেল। কবি ফররুখ আহমদ চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন। সাত সাগরের মাঝি বহু ক্লান্তির সমুদ্র পার হয়ে এসে অনন্ত বিশ্রামের নিবিড়ে আচ্ছন্ন হলেন। হয়তো একদিন ‘আবার’ পর্দা পেরিয়ে ভোর হবে, নারঙ্গী বনে সবুজ পাতা কাঁপবে প্রাণরসে থির থির করে। সাত সাগরের উত্তাল কলরোল এসে আঘাত হানবে দুয়ারে, কিন্তু মাঝির ঘুম আর ভাঙবে না। ফররুখ আহমদ আজ নেই। অন্ধকার এসে গ্রাস করেছে আলোকের উদ্দাম বিহঙ্গকে। যে বিহঙ্গের কণ্ঠে নিয়ত ধ্বনিত হয়েছে গান, কবিতা-ছড়া, পুঁথি পাঠ, আর সনেট। যে কণ্ঠে শুনেছি শিশুর মতো সরল হাসি, সে কণ্ঠ আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। আর কোনোদিনও কাকলীমুখর হয়ে উঠবে না।

ফররুখ আহমদ একজন বড়কবি এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও অধিকতর সত্য তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান পুরুষ। সেই ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদাবোধকে অক্ষুণœ রাখতে গিয়ে তাকে আমৃত্যু দুঃসহ দারিদ্র্র্যের হতে হয়েছে নিষ্পেষিত। কিন্তু কখনও উপর তলার দাক্ষিণ্যের দুয়ারে হাত পেতে নিজেকে তিনি খাটো করেননি এতটুকু। ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখে ক্ষমতার রোষানলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তিনি। আবার আইয়ুব শাহীর শেষ পর্যায়ে একটি সরকারি খেতাবও তাকে দেয়া হয়েছিল। সে পারিতোষিক তিনি গ্রহণ করেননি, কিন্তু কী আশ্চর্য আমরা তার এই মহৎ ত্যাগকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশে তাকে রেখেছিলাম কোণঠাসা করে। -দৈনিক আজাদ, ২২ অক্টোবর, ১৯৭৪

ফররুখ আহমদ আর নেই। কবিতার আকাশ থেকে ঝরে পড়ল উজ্জ্বল একটি জ্যোতিষ্ক। তমি¯্রা হনন করল আলোর সেই শিখাকে, বাঁকা তলোয়ারের মতো ছিল যার তেজ এবং প্রভা। আলোর সেই বিহঙ্গ আর গান গাইবে না, যার সুর, ছন্দ এবং কবিতা আনন্দের আপন একটি ভুবন সৃষ্টি করেছিল বাংলা সাহিত্যের বাগানে। হঠাৎ নিরুদ্দিষ্ট হলেন ‘সাত সাগরের মাঝি’র সেই অসামান্য শক্তিমান কবি, যার অন্বিষ্ট ছিল মুক্তির আলোকিত একটি বন্দর। যেখানে ক্ষুধিত কোনো মুখ হানবে না নীরব ভ্রুকুটি। যেখানে কালো পিচঢালা পথে পড়ে থাকবে না ক্ষয়িত কোনো লাশ। মানুষের অন্তিম কবর রচনা করবে না যেখানে ধনিকের গর্বিত সম্পদ। দারিদ্র্য এবং মনুষ্যত্বের অবমাননার বিরুদ্ধে যে কবি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ, তারই নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় ক্ষয়িত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি নিঃশব্দে। এ দুঃখ অনির্বাণ। এই শ্রেষ্ঠ কবির মৃত্যু গোটা বাংলা সাহিত্যকেই শুধু দরিদ্র করে দিয়ে গেল না, সেই সাথে এই সাহিত্যের কবিকুল, লেখক আর পাঠকদের আকীর্ণ করল এমন এক আত্মগ্লানিতে যা কখনো স্খলন করা যাবে না।

আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ, এমন একজন ব্যক্তিত্বশালী শ্রেষ্ঠ কবিকে বাংলা সাহিত্য হারাল অকালে। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। রোগশয্যায় মাইকেল মধুসূদনের মতো আমাদের সবার অলক্ষ্যে চারম দুর্গতির মধ্যে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করলেন সারা বাংলার এমন একজন মহান কবিশিল্পী। এ দুঃখ রাখবার ঠাঁই নেই কারো। নিজের জীবনে কবি আমাদের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হলেও এ অনুদারতার কিছুমাত্র স্খলন হতে পারে তার পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনে। কবি বলেছেন, ‘শেষ আছে সকলের; শুধু একা অন্তহীনকাল।’ তিনি নিজে আজ সে অনন্ত লোকের যাত্রী। কিন্তু তার কবিতাকে স্পর্শ করতে পারবে না মৃত্যু-এটাই আমাদের একমাত্র সান্ত¡না। অনন্ত শান্তি লাভ করুক তার আত্মা (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন) -দৈনিক বাংলা, ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪

কবি ফররুখ আহমদ আর ইহজগতে নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মাত্র ৫৬ বছর বয়সে লোকান্তরিত এই শক্তিমান কবির সমগ্র কাব্য আলোচনার সময় এবং স্থান এটা নয়। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, কাজী নজরুল ইসলামের পরে বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন সত্যিকার প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব ঘটে, ফররুখ আহমদ ছিলেন তার অন্যতম। ১৯৪৩-৪৪ সালে তার অমর কাব্য ‘সাত সাগরের মাঝি’র কবিতাগুলো রচিত হয় এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাঙালি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৪৪ সালে ‘সাত সাগরের মাঝি’ পুস্তকাকার প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই তার খ্যাতি তৎকালীন বাংলায় শুধু নয় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

মর্যাদাবোধ অটুট ছিল কবি ফররুখ আহমদের। তাই তিনি সস্তা প্রচারের লোভে কখনো লালায়িত হননি। তৎকালীন পাক-শাসক চক্র এই কবিকে আদৌ সুনজরে দেখতেন না। তার রচনা একদা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিষ্ঠুর অর্থাভাবে তিনি বিপর্যস্ত ছিলেন, তবুও আইয়ুবী আমলের পারিতোষিক ও পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনই হয়। নির্লোভ ও সততাসম্পন্ন মানুষই এমন অকালে চলে যায়। -দৈনিক গণকণ্ঠ, ২২ অক্টোবর, ১৯৭৪

গত ঈদসংখ্যা ইত্তেফাকের স্থান-কাল-পাত্রের এক জায়গায় লিখেছিলাম, “কোথায় ফররুখ আহমদ? ‘লাশ’-এর মতো অনবদ্য কবিতা আর দেখি না কেন?” আর আজ, -মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে ফররুখ আহমদের লাশ কবরে শুইয়ে রেখে এসে এই লেখাটি লিখছি। মরণশীল মানুষের নিকট মৃত্যু কোনো বড় কথা নয়। তবুও কোনো কোনো মৃত্যু এত বড়, এত বিরাট মনে হয় যে, তার নিকট জীবনও তুচ্ছ হয়ে পড়ে। ফররুখ আহমদের মৃত্যুতে আজ শুধু এই সান্ত¡নাই আমি খুঁজছি যে, মরণেও তার মুখে হাসির একটা আভা ছড়িয়েছিল। ‘মু’মিনের মৃত্যুর প্রধান লক্ষণ এই যে, মরণেও তার মুখে হাসির ঝলক লেগে থাকবে।

১৯৬৮ সালের আগে বা পরের কোনো সময় কলকাতা বেতার থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফররুখ আহমদের ওপর সারগর্ভ এক আলোচনা করেছিলেন। এরও অনেক আগে, ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার আগে, তদানীন্তন অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে নবীন কবি ফররুখ আহমদের ওপর আলোচনা সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের পর একমাত্র ফররুখ আহমদই সেদিন এ দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। [আখতারুল আলম (লুব্ধক), দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ অক্টোবর ১৯৭৪]

তার স্মরণে : ফররুখ আহমদ স্মরণে তৎকালীন ইসলামিক একাডেমি, বর্তমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের সভাপতিত্বে ২৫ অক্টোবর, ১৯৭৪ এক আবেগঘন শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, কবি-গবেষক আবদুল কাদির, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুল হুদা চৌধুরী, ব্যারিস্টার মোস্তফা কামাল, আসাফউদ্দৌল্লা রেজা, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, সাহিত্যিক আহমদ ছফা প্রমুখ।

বাংলা একাডেমিতেও এক স্মরণসভা মহাপরিচালিকা ড. নীলিমা ইব্রাহীমের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া লেখক শিবির কবি ফররুখ আহমদ স্মরণে এক সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি আবুল হোসেন।

কবি ফররুখ আহমদের ইন্তেকালে শোকবাণী প্রদানকারীদের মধ্যে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ডক্টর আলীম আল রাজী প্রমুখ রয়েছেন।

দুর্লভ তথ্য : ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪, মাগরিবের আজানের সময় কবি ইন্তেকাল করেন। ২০ অক্টোবর জোহরের নামাজের পর ইস্কাটন গার্ডেন মসজিদে কবির জানাজা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন সাইয়েদ মাওলানা মুহাম্মদ মাসুম। জানাজার পর কবি বেনজির আহমদের শাহজাহানপুরের বাগান বাড়িতে কবির দাফন সম্পন্ন হয়। কবির মৃতদেহ কবরে নামান মাওলানা সাদেক (ল্যাবরেটরি স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক), ডা. এস এ মাহমুদ (কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র) ও ভাষাসৈনিক ইবরাহীম ত্বহা।

নির্বাচন কশিনার মাহবুব তালুকদারের ভাষ্য : ১৯ অক্টোবর, ইস্কাটনের বাড়িতে বেশ কিছু কবি-সাহিত্যিক তাকে অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এসেছেন। কিন্তু সরকারি কোনো ব্যক্তি তার প্রতি সম্মান দেখাতে আসেননি। বিষয়টি খুবই খারাপ লাগলো। তখন তো আর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপ্রধান নেই যে, এ বিষয়ে তাকে গিয়ে বলব। আমি তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে ফোন করে বললাম, এত বড় একজন কবি ইন্তেকাল করলেন, কোনো সরকারি ব্যক্তি বা মন্ত্রী তাকে দেখতেও গেলেন না। আমার কথায় প্রতিমন্ত্রী এমন ভাব দেখালেন যে, আমার নিজেরই সেখানে যাওয়া ঠিক হয়নি। ঘটনার কী অদ্ভুত পরিহাস। মাত্র এক বছর পর শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ দেশের প্রেসিডেন্ট এবং তাহেরউদ্দীন ঠাকুর সে সময়েও ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী। দেশের কিছুটা খোলনলচে পালটে ফেলা হয়েছে তখন। জাতীয় পোশাকের বদৌলতে জাতির মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন সরকার নিজেদের ইসলামী মনোভাব প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সনের ১৯ অক্টোবর কবি ফররুখ আহমদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষভাবে উদযাপিত হবে না, তা হতে পারে না। তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ ফররুখ আহমদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ক্রোড়পত্র বের করল। কিন্তু দেশের ওই অবস্থায় কবি-সাহিত্যিক কারো লেখা পাওয়া গেল না। অগত্যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ফররুখ আহমদ সম্পর্কে যেসব প্রবন্ধ বেরিয়েছিল তারই উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণালি অ্যাডভারটাইজার্স (অ্যাড ফার্ম)-এর সৌজন্যে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হলো। নিঃসন্দেহে কবি ফররুখ আহমদ ভাগ্যবান। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বেসরকারি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সৌজন্যে তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সরকারি পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। ক’জন কবির ভাগ্যে এমন অযাচিত মরণোত্তর সম্মান জোটে? কিন্তু ফররুখ আহমদ বেঁচে থাকলে কোনো কবির মৃত্যুকে নিয়ে এহেন রাজনৈতিক প্রতারণার তীব্র প্রতিবাদ করতেন বলেই আমার বিশ্বাস।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শোক প্রকাশ :

Special Represntative (Paris)

Government of The People’s Republic of Bangladesh.

কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুর সংবাদ জেনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেন, পরম স্নেহাস্পদেষু, মাহবুবুল আলম তালুকদার।

প্যারিস থেকে ফিরে এসে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তোমার চিঠি পড়ে অবগত হই যে, শক্তিমান কবি ফররুখ মারা গিয়েছেন। কবি ফররুখ আহমদ সাহেবের বন্ধুত্ব লাভের সৌভাগ্য আমার একই বয়সে কলকাতায় হয়েছিল। তাঁর প্রতিভা আমাকে সে সময়ই মুগ্ধ করেছিল। তার অকাল মৃত্যুতে বাংলা ভাষার অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাণী : ১৯৭৯ সালে ফররুখ আহমদের ৬১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিম্নক্ত বাণী প্রদান করেন: Tribute to Farrukh : President Ziaur Rahman on Sunday night termed poet Farrukh Ahmed as the poet of life and youth and pioneer of Bangladeshi nationalism and Islami renaissance, reports BSS. In a message on the occasion of the 61st anniversary of birth of poet Farrukh Ahmed, the president said: I pray for the salvation of the departed soul of poet Farrukh Ahmed on the occasion of his 61st birth anniversary, who was the poet of life and youth, pioneer of Bangladeshi nationalism and Islami renaissance and a talented poet. I express my deep regards for his great poetic genious. I wish his immortal works will lead Bangladeshi nationalism ahead and always inspire the independent nation to reach its desired goal.

অর্থাৎ, ফররুখ আহমদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

রোববার রাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কবি ফররুখ আহমদকে জীবন ও তারুণ্যের কবি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে অভিহিত করেছেন- বিএসএস সূত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।

কবি ফররুখ আহমদের জন্মজয়ন্তীর ৬১তম বার্ষিকী উপলক্ষে এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন-

‘জীবন ও তারুণ্যের কবি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত ও ইসলামী পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ কবি ফররুখ আহমদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমি তাঁর অসাধারণ কাব্য প্রতিভার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আশা করি, তার অমর সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে আরও শক্তিশালী করবে এবং স্বাধীন জাতিকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।’

‘প্রয়াত কবি ফররুখ আহমদের সাহিত্যকর্ম চিরকাল জাতিকে অগ্রগতির পথে অনুপ্রাণিত করবে। বাংলাদেশি জাতি কখনো তার সাহিত্য অবদান ভুলতে পারবে না।’

তিনি ফররুখ আহমদকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ বলে উল্লেখ করেন এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

(সূত্র : দি বাংলাদেশ অবজারভার, ১১ জুন ১৯৭৯; বঙ্গবভনে পাঁচ বছর, মাহবুবুল তালুকদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, মুক্তিযোদ্ধা, কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার)

পরবর্তী পাঁচ দশক যেমন ফররুখের অনেক অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, পুরনো বইয়ের নতুন সংস্করণ হয়েছে, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘কবিতা সমগ্র’ ও ‘ফররুখ রচনাবলী’র প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি রেডিও-টেলিভিশনে, পত্রপত্রিকায় তার আলোচনার ধারা প্রবহমান, অনেক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকায় বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মোট কথা, ফররুখ মৃত্যুর আগে যেমন তেমনি মৃত্যুর পরও বহুল আলোচিত-সমালোচিত এক কবি-ব্যক্তিত্ব রূপেই আজও বিরাজমান। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য থাকবে ততদিন ফররুখও আলোচিত হবেন।