হাওরাঞ্চলের পানি কমতে না কমতেই নিকলীর নদীচরগুলোতে শুরু হয়ে যায় দখল ও ভাগ-বাটোয়ারার নানা তোড়জোড় ও দ্বন্দ্ব। সরকারিভাবে নদীচরগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হলেও স্থানীয়ভাবে তার ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রতি বছরই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীতীরের এসব চরের মালিকানা সরকার হলেও উপজেলা প্রশাসন কখনো কখনো ব্যক্তি পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয় বলে নানা অভিযোগ উঠেছে। ফলে সরকার হারাচ্ছে মূল্যবান চরভূমি, আর সৃষ্টি হচ্ছে সহিংসতা ও আইনি জটিলতা।
বাংলাদেশ জমি ব্যবস্থাপনায় বিশ্বমানের স্বীকৃতি পেলেও মাঠপর্যায়ে এখনো ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ, দখলদারিত্ব ও মামলার জট নিষ্পত্তিতে জটিলতা দূর হচ্ছে না। নিকলীর ছাতিরচর ও গুরই এলাকায় প্রতি বছরই চরের দখল নিয়ে সঙ্ঘাত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা বলছেন, যাদের শক্তি আছে, তাদের নানা কৌশলে চরের মালিকানা দাবি করেন। এমনকি প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তি এতে পক্ষপাতিত্ব করে এতে নিজেরাও সুবিধা নিয়ে থাকেন।
গত ১৮ নভেম্বর গুরই ও ছাতিরচর ইউনিয়নের মধ্যে চর দখলকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোটা, দা, বল্লম ও টেঁটা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। উত্তেজনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে হাওরের কয়েকটি দ্বীপের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
পরদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসি ল্যান্ড মৌজাভিত্তিক কাগজপত্র যাচাই করে শুক্রবার (গতকাল) সরেজমিন নকশা অনুযায়ী চর বণ্টনের নির্দেশ দেন। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, অতীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অধীন একটি পক্ষ চরের দখলে ছিল। বর্তমানে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন। রাজনৈতিক এই পালাবদলের সাথে সাথে দখলদারিত্বেও হাতবদল হয়েছে। ছাতিরচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি পরশ মাহমুদ বলেন, যাদের কাগজপত্র সঠিক আছে তারাই চরের জমি পাবেন। বছরের পর বছর মসজিদের নামে দখলের বিনিময়ে টাকা লেনদেন হতো, এবার তা হবে না। তিনি আরো জানান, চরের আয় ৯টি মসজিদে বণ্টন করা হবে।
গুরই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির সভাপতি আবু তাহের বলেন, গত ১৭ বছর বিয়াতিরচর এলাকার লোকজন ওই চরের ভোগদখলে ছিল। এবার বিরোধ বড় আকার নিয়েছে। তবে প্রশাসনের নির্দেশে মৌজা অনুযায়ী বণ্টন মেনে নেয়া হয়েছে। সরকারের ১ নম্বর খতিয়ানে জমি রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও সিএস ও আরএস নথিতে ওই চরের জমিগুলো স্থানীয়দের নামে থাকা দাবি করে তিনি মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী আরিফ উদ্দিন বলেন, চর দখল নিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যবস্থা নেয়ায় বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তিনি জানান, পরদিন এসি ল্যান্ড অফিসে বণ্টন নিয়ে সালিশে নিরাপত্তার অংশ হিসেবে চারজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। নিকলী উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তা পতিক দত্ত বলেন, মৌজা অনুযায়ী দুই ইউনিয়নের মধ্যে সমানভাবে চর ভাগ করে দেয়া হয়েছে। তবে সরকারিভাবে চর রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি পর্যায়ে বণ্টন কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি সিএস, আরএস নথি, পুরোনো মামলা এবং ২০১৪ সালের লিজের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বর্তমানে সেই লিজ ব্যবস্থাও বাতিল হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি এক পর্যায়ে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এদিকে চর দখল প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আসলাম মোল্লার কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি ঢাকায় একটি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি। হাওরাঞ্চলে চরভূমি নিয়ে এমন দখল-বিবাদ প্রায় প্রতিবছরই তীব্র আকার ধারণ করে। পানি শুকোনোর সাথে সাথেই দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সেই সাথে প্রশাসনের ব্যস্ততা বাড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও জমির বণ্টন বিষয়ে সালিশ করতে। স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কঠোর তদারকি ছাড়া এসব চরের জমি দখলদারিত্ব হয়তো বন্ধ হবে না।



