কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় সুন্দরবনের চিংড়ি জোনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রাকৃতিক বৈরী আবহাওয়া, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, ঘেরের গভীরতা হ্রাস, প্যারাবন ধ্বংস ও খাল দখলের কারণে চিংড়ি উৎপাদনে ধস নেমেছে। এতে কয়েক হাজার চাষি ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন বলে তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
চকরিয়া উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, ২০২২ সালে উপজেলার রামপুর, বদরখালী, খুটাখালী, বহলতলী ও ডুলাহাজারা মৌজার ছয় হাজার ৮২৮টি ঘেরে আট হাজার ৪২০ টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। ২০২৩ সালে ঘের বেড়ে সাত হাজার ৪৪৭টি হলেও উৎপাদন হয় ৯ হাজার ২১৬ টন। ২০২৪ সালে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে ৯ হাজার ৫১৬ টন হলেও চলতি মৌসুমে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র চার হাজার মেট্রিক টন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর বা ৫৬ হাজার একর জমিতে ৯ হাজার ৫৮৯টি নিবন্ধিত মৎস্য ঘের রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশের অন্যতম এই চিংড়ি জোন এখন মারাত্মক সঙ্কটের মুখে পড়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনের সময় স্থানীয় চিংড়িচাষিরা জানান, এ বছর বৈরী আবহাওয়া, বৃষ্টির অভাব এবং অতিরিক্ত গরমে পানির লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ফলে, ঘেরে চিংড়িতে বারবার মড়ক দেখা দেয়। এক সময় প্রতি হেক্টরে যেখানে ৫০০ কেজি চিংড়ি পাওয়া যেত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২০০ কেজিরও নিচে। ঘেরে পলিমাটি জমে গভীরতা কমে যাওয়ায় মাছ উৎপাদনও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী প্যারাবন গাছগুলো নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। তা ছাড়া পানি প্রবাহের খালগুলোও স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রগুলো দখল করে নিয়ে সেখানে মাছ চাষ করছে। এতে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে ঘেরে লবণাক্ত পানির ঘাটতি দেখা দেয়ায় চিংড়ি চাষের জন্য তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন বলেন, চকরিয়ার চিংড়ি জোন দেশের বৃহত্তম মৎস্যভাণ্ডারগুলোর একটি। কিন্তু এ বছর বৈরী আবহাওয়া, খাল দখল, ঘেরের গভীরতা হ্রাস ও পোনা সঙ্কটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন এ অঞ্চলের হাজারো চিংড়িচাষি।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চকরিয়ার রামপুর এলাকায় ৭২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ ও ২৩টি আধুনিক সøুইসগেট নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি প্রায় তিন লাখ বাইন ও কেওড়া গাছ রোপণ করে প্যারাবন সৃজন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হলে চিংড়ি চাষের পরিবেশ কিছুটা উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।
চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, এক সময় চকরিয়া উপকূলীয় অঞ্চলের সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ ছিল। এখন সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। অন্তত ১১টি খাল রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্যারাবন নিধন ও অনিয়ন্ত্রিত দখলদারির কারণে চিংড়ি চাষ ভয়াবহ রূপে ব্যাহত হচ্ছে।
চিংড়ি চাষে সুদিন ফেরানোর দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, চিংড়ি ঘের অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে হবে, চাঁদাবাজি ও ঘের মালিকদের জিম্মি করে অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। প্রতি মৌসুমে জোয়ারের সময় ঘেরে চাঁদাবাজ ও ডাকাতদের তাণ্ডব চাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা না নিলে চিংড়ি চাষ ফের মুখ থুবড়ে পড়বে।
চকরিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশ সজাগ রয়েছে। চাষিদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওসি জানান, চিংড়ি জোন এলাকার বেশির ভাগ স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা নদীপথ নির্ভর হওয়ায় নিয়মিত টহল দেয়া সম্ভব হয় না। তবে এখন টহল কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে, যাতে ঘের মালিক ও চাষিরা নিরাপদে চিংড়ি চাষ করতে পারেন।
চকরিয়ার উপকূলীয় সুন্দরবন ঘেরা বিস্তীর্ণ এলাকা একসময় দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস ছিল। কিন্তু আজ সেখানে প্যারাবন নিধন, খাল দখল, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা। তাদের আশা- প্রকৃতি ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগেই হয়তো ফিরে আসবে চিংড়ির সেই সোনালি দিন।