বন্যা ও ভাঙনে উপকূলে জনজীবনে ঝুঁকি বাড়ছে

৪ জেলায় বন্যার আশঙ্কা

পূর্ব উপকূলে জোয়ারভাটার ব্যবধান বা টাইডাল রেঞ্জ বৃদ্ধিতে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এতে করে উপকূলের জনজীবনে বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানা গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

সময়ের সাথে বদলে যাচ্ছে উপকূল। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে পশ্চিম উপকূলের তুলনায় দ্রুত ডুবছে পূর্ব উপকূল। এ ছাড়া পূর্ব উপকূলে জোয়ারভাটার ব্যবধান বা টাইডাল রেঞ্জ বৃদ্ধিতে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এতে করে উপকূলের জনজীবনে বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানা গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।

গবেষণা তথ্য বলছে, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব উপকূল, পশ্চিম উপকূলের তুলনায় আরো দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৪ দশমিক ৭৩ মিলিমিটার বাড়ছে, যা সর্বোচ্চ। সে তুলনায় পশ্চিমের সুন্দরবন জোয়ারভাটা সমভূমিতে এই হার ৩ দশমিক ৬৬ মিলিমিটার এবং কেন্দ্রীয় মেঘনা মোহনা সমভূমিতে ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অবকাঠামো, বিস্তীর্ণ কৃষিজমি এবং লাখো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

‘ইস্টিমেটিং ভার্টিক্যাল ল্যান্ড মোশন-অ্যাডজাস্টেড সি লেভেল রাইজ ইন আ ডেটা-স্পার্স অ্যান্ড ভালনারেবল কোস্টাল রিজিয়ন’ শীর্ষক গবেষণায় কয়েক দশকের জোয়ার-ভাটা পরিমাপ, স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি ও রাডারভিত্তিক রিমোট সেন্সিং ব্যবহার করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, হিমবাহ গলন, সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, পলি ক্ষয়সহ প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং মানুষের হস্তক্ষেপ সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পোল্ডার ও বাঁধ জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

গড় হিসেবে দেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রতি বছর ৪ দশমিক ৫৮ মিলিমিটার বাড়ছে। এটি বৈশ্বিক গড় (৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার) থেকে অনেক বেশি। আগস্টে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী জিওমেটিক্স, ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস অ্যান্ড রিস্কের গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূমি ধস এই হুমকিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থা (আইপিসিসি) জানিয়েছে, ১৯৬০ এর দশকের পর থেকে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি দ্রুততর হয়েছে। ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি গড়ে প্রতি বছর ২ দশমিক ৩ মিলিমিটার করে বাড়লেও ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণার প্রধান আশরাফ দেওয়ান গণমাধ্যমকে বলেছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমতলভূমিতে দ্রুত নগরায়ন এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বৃহৎ প্রকল্পের গভীর পাইলিং ভূমি ধসে অবদান রাখছে। এ ছাড়া এখানে জোয়ারভাটার তীব্রতাও বেশি। অন্য দিকে পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তীর্ণ সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সেখানে ঘন নগর কাঠামো নেই, বেশির ভাগ জমিই কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। পশ্চিমে সুন্দরবন প্রাকৃতিক বাফার হিসেবে কাজ করলেও পাহাড় বাদে পূর্বে ভূমি সমতল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

তার ভাষ্য, চট্টগ্রামের সদরঘাট ও টেকনাফের মতো কিছু এলাকায় ভূমি উঁচু হচ্ছে, কারণ পূর্বাঞ্চলটি ভূ-টেকটোনিকভাবে সক্রিয়। আমাদের অবকাঠামো জলবায়ু সহনশীল নয়। ব্যবস্থা না নিলে পূর্ব উপকূলে অনেক অবকাঠামো ভবিষ্যতে ধ্বংস হয়ে যাবে। কৃষিজমি ডুবে যাবে, ফসল উৎপাদন কমে যাবে, বিপন্ন হবে লাখো মানুষের জীবিকা।

স্থানভিত্তিক সমাধানের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ভূমি ধস ও সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে লক্ষ্যভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজন এবং অবকাঠামো পরিকল্পনার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন। যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, ভূমির গতিশীলতা এবং জোয়ার-ভাটার ধরন ভিন্ন, সেখানে সাধারণ নীতি কার্যকর হবে না। তাই অবকাঠামো নকশার সময় জলবায়ুর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। পাশাপাশি দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশল প্রতিটি অঞ্চলের বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী তৈরি হতে হবে।

উত্তরাঞ্চলের ৪ জেলায় বন্যার শঙ্কা

এ দিকে উজানে ও দেশের উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির ফলে বন্যার আভাস দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামে নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে। রংপুর বিভাগের তিস্তা, দুধকুমার ও ধরলা নদনদীর পানি আগামী দুই দিন দ্রুত বাড়তে পারে। আর এতে এসব নদনদীসংলগ্ন এলাকায় সাময়িক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। দেশের ভেতরে এবং উজানে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির কারণে এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে। আগামী ১২ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এর কারণ তিস্তা নদীর উজানে দোমোহনিতে ১৫৮ সেন্টিমিটার এবং গজলডোবাতে ২২০ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে।

রংপুর বিভাগ এবং উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ সময়ে পঞ্চগড়ে ১১৮ মিলিমিটার, নীলফামারীর ডালিয়ায় ৮৫, কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে ৭৫ মিলিমিটার এবং উজানে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে ২৬১, কোচবিহারে ১৯০, জলপাইগুড়িতে ১৭২, শিলিগুড়িতে ১৩৪, অরুণাচল প্রদেশের পাসিঘাটে ৮৯ এবং সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে।

এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ভারী বৃষ্টির মধ্যে ভূমিধসে দার্জিলিংয়ে ১৭ জন নিহত হয়েছে। ভূমিধসের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর সাথে দার্জিলিংয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের সংযোগকারী সড়ক এবং দার্জিলিং ও শিলিগুড়ির সংযোগকারী সড়ক।

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর এবং বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, রোববার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা এবং আশপাশের সময়ে রংপুর বিভাগে এবং উজানে পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে ভারী (দিনে ১৪৪ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (দিনে ১৮৮ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাত হতে পারে।

বুলেটিনে বলা হয়েছে, তিস্তা নদী বিপদসীমার ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ওপর পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে। পরবর্তীতে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসায় পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে এবং বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

তাতে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি ৭ অক্টোবর সকাল ৯টা পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং আগামী ১২ ঘণ্টায় বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ওপর পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

অপর দিকে ভুটান আবহাওয়া ও পানি বিজ্ঞান সংস্থার বরাত দিয়ে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ‘ওয়াংচু’ নদীর পানি ‘তালা’ বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাবে ধরলা ও দুধকুমার নদীর উজানে ভারতে দ্রুতগতিতে পানি বাড়ছে।