মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ঘোষিত শুল্ক নীতি বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত তৈরী পোশাক শিল্পের ওপর বড় ধাক্কা বলে ধরা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন কোভিড, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ যে শিল্পটিকে তাদের সমৃদ্ধি অর্জনে অন্যতম প্রধান ভরসা হিসেবে ধরে রেখেছিল, সেটি হলো তৈরী পোশাক শিল্প। এই শিল্পের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির ফলে তাদের এই শিল্প এখন বড় সঙ্কটে পড়েছে। তারা বলছেন ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্ক নীতি বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে বড় আঘাত। এমন পরিস্থিতিতে তৈরী পোশাক রফতানিতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন, যা এশিয়ার এই স্বল্পোন্নত দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাতকে কঠিন সঙ্কটে ফেলতে পারে।
বিজিএমইএ এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিদুল্লাহ আজিম নয়া দিগন্তকে বলেন আমেরিকার এমন ঘোষণায় তিনি হতবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা জানতাম যে কিছু একটা আসছে, কিন্তু এত বড় ধাক্কা আসবে তা কল্পনাও করিনি। এটি আমাদের ব্যবসার জন্য ও হাজার হাজার শ্রমিকের জন্য ভয়ঙ্কর খবর। তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠান উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতাদের জন্য পোশাক সরবরাহ করে। তিনি জানান, এই নতুন শুল্কের কারণে বিদেশী ক্রেতারা বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকতে পারে, যা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয় ও প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এ ছাড়া দেশের জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ এই শিল্প থেকে আসে। তাই, এই নতুন শুল্ক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কারণ তারা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখন কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা বাড়ানো। সেই সঙ্গে বিকল্প বাজার খোঁজা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি বাড়ানোর কৌশল নিতে হবে।
পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের প্রধান আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকেই মার্কিন ক্রেতারা ভারতকে বিকল্প হিসেবে দেখছিল। এখন নতুন শুল্কের কারণে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। তিনি বলেন ভারতীয় পোশাক রফতানির ওপর শুল্ক হার ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৩০টি পোশাক ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী হওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির মাত্র ৬-৭ শতাংশ আসে ভারত থেকে, যা বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের তুলনায় কম। তবে নতুন পরিস্থিতিতে ভারত এই বাজারে আরও বড় অংশ দখল নিতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি মারাত্মকভাবে আঘাত হানবে। কারণ নতুন করের হার বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা সব আইটেমের জন্য ইমপ্লিকেবল হবে। নতুন করের হারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে। ফলস্বরূপ, আমেরিকান ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং তারা ভোক্তাদের আইটেমগুলোর জন্য কম ব্যয় করবে। অন্য দিকে, নতুন শুল্কের হার মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। ফলে বৈশ্বিক ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেবে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের জন্য কিছুটা স্বস্তি রয়েছে, কারণ নতুন শুল্কের হার পাকিস্তান, ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া এবং আরও অনেক দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নীতি বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের বিবেচনা করা উচিত যে এটি কত দিন টিকে থাকবে বা থাকবে কি না, কোনো বিনিময় আছে কি না, যা করের হার কমাতে সাহায্য করতে পারে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, যে ট্যারিফ বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয়েছে সেটা আমাদের ওপর হওয়ার কথা না। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরী পোশাক রফতানির এভারেজ ডিউটি ১৫.২ শতাংশ। আমেরিকাতে কিন্তু পণ্যের আইটেম অনুযায়ী ডিউটি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে গড়ে ১২.৫ শতাংশ। আমেরিকায় পলেস্টারে একরকম, নিটে একরকম, উলে একরকম, ট্রাউজারে একরকম। একেকটায় একেক রকম ডিউটি। কিন্তু গড়ে সেখানে ১৫.২ শতাংশ।
তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, যন্ত্রপাতি এবং পোশাক শিল্পের জন্য যেসব পণ্য আমদানি করি তার অধিকাংশ শুল্কমুক্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ শতাংশ। ডিউটি বাড়ানোর প্রভাব তো পড়বেই। হয়তো টোটাল টার্নওভার কমে যাবে যুক্তরাষ্ট্রে। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের তৈরী পোশাক আমদানি করে। সেখানে ১০ শতাংশ আমদানি হয়তো কমে যাবে। ফলে আমাদের ওপর এর প্রভাব অবশ্যই পড়বে। কারণ আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার হলো আমেরিকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের তথ্য অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৫.৯৩ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল, যা আগের বছরে ছিল ৭.২৮ বিলিয়ন ডলার।
বিজিএমইএ এর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল নয়া দিগন্তকে বলেন, যখন আমরা মনে করছি বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করেছে, চায়নার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে শুল্ক বাড়াচ্ছে সেই সুবিধা নেবে বাংলাদেশ। কিন্তু নতুন এ শুল্কারোপের কারণে সেই সুবিধা আর পাচ্ছি না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে, আমাদের আগে আছে ভিয়েতনাম ও চীন। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশ হিসাবে আছে কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কা। চীন ছাড়া এসব দেশের শুল্ক আমাদের দেশ থেকে বেশি বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখানে কিছুটা সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা আসবে না।