সরকার গেলে দখলদার বদলায় পাল্টায় না নদীর ভাগ্য

দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারিয়েছে কয়েক শ’ নদী

আবুল কালাম
Printed Edition
বুড়িগঙ্গার পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। বাবুবাজার এলাকার দৃশ্য : আবদুল্লাহ আল বাপ্পী
বুড়িগঙ্গার পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। বাবুবাজার এলাকার দৃশ্য : আবদুল্লাহ আল বাপ্পী

ক্ষমতার পরিবর্তনে সরকার যায়, সরকার আসে। সময়ের সাথে পাল্টে যায় সব দৃশ্যপট। হাত বদলে চোখের পলকে দখলদার বদলালেও পাল্টায় না দেশের নদীর ভাগ্য। ফলে অব্যাহত দখল-দূষণে মুমুর্ষু নদী এক সময় প্রাণ হারায়। এভাবে করে বিগত কয়েক যুগে দেশের কয়েকশ’ নদী অস্থিত্ব হারিয়েছে। আর যা আছে তা দখল-দূষণে কোথাও সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। আবার কিছু নদী পানিপ্রবাহের গতিপথ হারিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগসহ নদী উদ্ধারে দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও এখন অনেকটা থেমে আছে অভিযান কার্যক্রম। ফলে প্রভাবশালীদের অপতৎপরতা আর বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় দূষণে মরছে নদী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী রক্ষায় একাধিক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রয়েছে। তবু এর রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক প্রভাব। তাদের ভাষ্য, এক সরকার গেলে আরেক সরকার আসে। তাতে দখলদার বদলায়। কিন্তু তাতে নদীর ভাগ্য বদলায় না। কারণ আগে যারা দখল করেছে তাদের পথ অনুসরণ করেই নতুনরা একই অপরাধ চালিয়ে যায়। এর পেছনে রাজনৈতিক শক্তি সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী দখলের মহোৎসবে মেতেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নদীর বুকে অবৈধ মাছবাজার গড়ে তুলেছিলেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। কর্ণফুলী রক্ষার দায়িত্ব যে সংস্থার সেই বন্দর কর্তৃপক্ষও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ভরাট করে নদী ইজারা দিয়েছে প্রভাবশালীদের। আর ‘তরফদী সাদী’ মিঠাপুকুরের যমুনেশ্বরী নদীর বালুমহাল থেকে সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হতো নদীর বালুয়া রঘুনাথপুর থেকে। একই অবস্থা ছিল চাঁদপুরে। সাবেক মন্ত্রী দিপু মনির ছত্রছায়ায় তার আস্থাভাজন সেলিম চেয়ারম্যান বিগত সময়ে সেখানে নদী দখলের মহাযজ্ঞ চালিয়েছে। যদিও সরকার পরিবর্তনের সাথে গণপিটুনিতে নিজ এলাকায় তিনি মারা যান।

অপর দিকে নদী দখল-দূষণ ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সরকারি খাস জমি দখলের এ যাবৎ সব রেকর্ডের ইতিহাস ভঙ্গ করেছে মেঘনা গ্রুপ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত মেঘনা নদীর শত শত বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়ে পঁচিশটি শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। এই শিল্প কলকারখানা গড়তে যেয়ে বছরের পর বছর মেঘনা গ্রুপ মেঘনা নদীকে গ্রাস করেছে। কিন্তু এরা প্রভাবশালী হওয়াতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এভাবে বিগত বছরে দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রভাবে চলেছে নদী দখল-দূষণ। কিন্তু সরকার বদলের পর একই অবস্থা চলছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দখলদার বদল হলেও নতুন করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নদী দখল অব্যাহত রয়েছে। ফলে দখন হওয়া নদ-নদী উদ্ধারের পরিবর্তে প্রাণ হারাতে বসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের নদ-নদীগুলো প্রধানত পাঁচ সঙ্কটে পড়েছে। এগুলো হলো- প্রবাহ স্বল্পতা, দখল, দূষণ, বালু-পাথর উত্তোলন ও ভাঙন। এর বাইরে আরেকটি বড় কারণ দূষণ। ঢাকার চারপাশের চার নদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর দূষণ সীমাহীন। এর বইরে সারা দেশে চলছে দখল-দূষণের আগ্রাসী প্রতিযোগিতা। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও নানা ফাঁকফোকর আর সীমাবদ্ধতায় তা থমকে যায়। কারণ ইতোমধ্যে যারা কমিশনের দায়িত্বে আসছেন তারা কেউই স্বাধীন এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। যার কারণে কেউ ব্যর্থ, আবার কেউ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন।

কমিশনে প্রথম চেয়ারম্যান আতহারুল ইসলাম। তিনি নদীর পক্ষে থাকলেও নদী সুরক্ষায় সাহসী কোনো ভূমিকা নেননি। এরপর কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি নদী সুরক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তার সময়ে নদী রক্ষা কমিশন সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দায়িত্ব দেয়া হয় এ এস এম আলী কবীরকে। সে সময়ে কমিশন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। তার মৃত্যুর পর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি এসে কমিশনকে আবার নদীর জন্য সক্রিয় করে তোলেন। তিনি শুরু থেকে এ জন্য সাহসী ভূমিকা রাখলে কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। এভাবে করে একের পর এক প্রতিকূলতায় এর কাজ বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। ফলে যারাই দায়িত্বে আসছেন তারা এসব মোকাবেলায় কাজের আগ্রহ হারিছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, ব্যক্তি ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও নদীর দখল-দূষণ চলছে। যার অন্যতম উন্নয়নের নামে নদীর জায়গা দখল। শিল্প-কারখানার অপরিশোধন বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্য, প্লাস্টিকসহ নানারকম অপচনশীল দ্রব্য নদীতে ফেলে দূষণ করা হচ্ছে। এর বাইরে অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন, চাষাবাদ ও মাছ ধরার জন্য নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহ সঙ্কুচিত করা হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখা উপনদী মিলে প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। তবে দেশের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদ-নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে নদী দখলদারদের সংখ্যা আরো বেশি। নদী কমিশনের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে নদীখেকো ৪৭ হাজার। এর মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জেই ১৯৮ দূষণকারী। ঢাকার টঙ্গী থেকে সদরঘাট হয়ে ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদী দূষণে জড়িত ১২০ প্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জে নদী দূষণের তালিকায় রয়েছে ৭৪টি প্রতিষ্ঠান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের অনেক স্থানে দখলদাররা নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে অনেকে বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এমনকি নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে হাটবাজারও বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ছাড়াও এসবের সাথে স্থানীয় ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।

এ বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) (অতিরিক্ত সচিব) মো: আবুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী দখল দূষণে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ডিসিদের এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী হলো রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু এসব রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এ জন্য দায়ী। তাই যারা চেয়ারে বসে নদী রক্ষার দায়িত্বে আছে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, নদ-নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ করাই এনআরসিসির প্রধান কাজ। কারণ দেশের নদ-নদীর অভিভাবক এনআরসিসি। কিন্তু এর মধ্যে সিএস ম্যাপের অজুহাতে ৩৭ হাজারের বেশি দখলদারের তথ্য মুছে দিয়ে তাদের দায়মুক্তি দিয়েছে এনআরসিসি। কমিশন এমন ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে থাকলে অল্প দিনের মাথায় দেশের বড় বড় নদীও মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে।