নদীতে কমে আসছে ইলিশের বিচরণ

দূষণের কারণে সাগর থেকে ইলিশ মাছ নদীতে উঠে আসছে না। তা ছাড়া নদীতে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে দূষণ। যার কারণে মেঘনা-পদ্মা নদীতে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা মিলছে না।

আবুল কালাম
Printed Edition
  • বিপর্যয়ের ৯ কারণ
  • আকাশছোঁয়া দাম
  • কমেছে অর্ধ লাখ টন

দিন দিন নদীতে কমছে ইলিশের বিচরণ। ফলে ভরা মৌসুমেও পদ্মা ও মেঘনায় আশানুরূপ ইলিশের দেখা মিলছে না। গবেষণা বলছে, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ নদীর নিচ দিকে নেমে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দূষণের কারণে সাগর থেকে ইলিশ মাছ নদীতে উঠে আসছে না। তা ছাড়া নদীতে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে দূষণ। যার কারণে মেঘনা-পদ্মা নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা মিলছে না।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত ৯ কারণে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, নদনদীর ক্রমাগত দূষণ, নাব্য সঙ্কট এবং সীমান্তের ওপারে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া বছরজুড়ে চলা তাপপ্রবাহ, অপ্রতুল বৃষ্টিপাত, পানির স্বল্পতা, নদীর তলদেশ ভরাট এবং শিল্পবর্জ্য ও পলিথিনে দূষিত পানি। এসব কারণে নদীতে ইলিশের বিচরণের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। ফলে দিন দিন নদীতে কমে আসছে ইলিশ মাছ।

মৎস্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশের মোট উৎপাদন হয়েছে ৫.২৯ লাখ টন। অথচ এর আগের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পরিমাণ ছিল ৫.৭১ লাখ টন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন কমেছে প্রায় অর্ধ লাখ টন।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মেঘনা নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে একাধিক শিল্পকারখানা, যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই সব কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে মেঘনা ও মেঘনার শাখা নদীগুলোতে। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে নদী দূষণ। অন্য দিকে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানি মুন্সীগঞ্জ জেলা হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মোহনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অন্য দিকে পদ্মায় বালু নিয়ে দিনরাত চলছে অসংখ্য বাল্কহেড। এ সব বাল্কহেডের ধোঁয়া, ইঞ্জিনের তেল-পানিতে মিশে বাড়ছে দূষণ। যার কারণে সাগর থেকে ইলিশ মেঘনা নদী হয়ে পদ্মা নদীতে উঠে আসছে কম। ফলে পদ্মা মেঘনায় কমেছে ইলিশ মাছের সংখ্যা।

ক্রেতারা বলছেন, ভরা মওসুমেও তাদের সামর্থ্যরে বাইরে ইলিশ। অন্যান্য বছর এ সময়ে যে ইলিশের দাম কেজি ছিল হাজার থেকে এক হাজার সাতশ’ টাকা বর্তমানে তার দাম দ্বিগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়।

বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে এক কেজি থেকে শুরু করে তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকায়। আর এক কেজির কম ইলিশের দাম এক হাজার চারশ’ থেকে দুই হাজার। আর ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশের কেজি নয়শ’ থেকে এক হাজার দুইশ’ টাকা। তাদের ভাষ্য, গত সপ্তাহের বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেরা সমুদ্রে যেতে না পারায় ইলিশের সরবরাহ কমেছে। ছুটির দিনে বাজারে এলেও আকাশছোঁয়া দাম দেখে অনেকেই ইলিশ না কিনেই হতাশ হয়ে ফিরেছেন। আর দেশের অন্যান্য বাজারগুলোতে এ সময়ে ইলিশের দেখা মিললেও চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। বিশেষ করে এক কেজি ওজনের ইলিশ এখন প্রায় অনুপস্থিত।

তবে সাগরের ইলিশের থেকে নদীর ইলিশের দাম তুলনামূলক বেশি জানিয়ে বিক্রেতারা বলেন, দেড় কেজি ওজনের ইলিশের হালি ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এক কেজি ওজনের আট থেকে ১০ হাজার টাকা। ৫০০ গ্রাম থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের হালি পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, এক দিকে নাব্যতা সঙ্কটের কারণে কমছে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র। এতে হতাশায় দিন কাটছে জেলেদের। অন্য দিকে নদী দূষণ, প্রতিকূল আবহাওয়া, নদীর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা নদীতে জাল ফেলতে না পারায় মাছ পাচ্ছেন না।

অপর দিকে মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদী দিয়ে অবাধে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল বেড়েই চলেছে। গত কয়েক বছর যাবৎ পদ্মা সেতু এলাকা ও যমুনা নদী থেকে বালু নিয়ে মুন্সীগঞ্জের পদ্মা-মেঘনা হয়ে বাল্কহেড চলছে অহরহ। আর পদ্মা নদীর মুখ ভাষানচরে নাব্যতা সঙ্কটের কারণেই ইলিশ পদ্মা, মেঘনায় আসতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ইলিশের ভরা মৌসুম চললেও জালে ধরা না পড়ায় নিরাশ জেলেরা।

বিরাজমান অবস্থা মোকাবেলায় ইলিশের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন নিশ্চিত করতে নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।