উত্তরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা

গতকাল তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা ও ধরলার অববাহিকার ১০৮ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মার পানিও বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া রংপুরের একটি বাড়ি
বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া রংপুরের একটি বাড়ি |নয়া দিগন্ত

  • তিস্তার পানি বিপদসীমার উপরে
  • হু হু করে ফুলে উঠছে পদ্মা
  • ৬ জেলায় দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
  • তিস্তা ও ধরলার ১০৮ স্থানে ভাঙন
  • কুষ্টিয়ার এক হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত

ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব ক’টি গেট খুলে দেয়ায় সৃষ্ট ঢল এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পানি প্রবলবেগে তিস্তায় আছড়ে পড়ার কারণে ডালিয়া ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা ও ধরলার অববাহিকার ১০৮ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এসব ভাঙনকবলিত স্থান এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ দিকে উজানের ঢল ফারাক্কা ব্যারাজ হয়ে পদ্মা নদীতে পড়ায় কুষ্টিয়ার এক হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পদ্মার পানিও বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ার দু’টি ইউনিয়ন পানিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই পদ্মা হু হু করে ফুলে উঠছে। উজানের ঢল এভাবে ধেয়ে আসতে থাকলে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রংপুর অফিস জানায়, ভারতের গাজলডোবা গেটের সব ক’টি গেট খুলে দেয়ায় এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উজানের পানি আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশের তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডালিয়া ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গতকাল বুধবার বেলা ৩টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী ও অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে তথ্য দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রেরও একই অবস্থা। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, পাট ও সদ্য রোপিত আমন ধান বানের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শতশত পুকুর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাথে সমানতালে চলছে ভাঙন। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে এই অববাহিকা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব নয়া দিগন্তকে গতকাল জানান, বেলা ৩টায় লালমনিরহাটের দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ৫২ দশমিক ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও ব্যারাজ রক্ষায় ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার সকাল ৯টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় ২০০ দশমিক ০, রংপুর ২১ দশমিক ৪ এবং উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচ বিহার ১০ দশমিক ৫ ও আসামের গোয়াহাটিতে ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এ ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগগুলোতে ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা আরো জানান, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব ক’টি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে উজানে ভয়াবহ রকম পানি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ভাটিতে বাংলাদেশের পাঁচ জেলার ১৪ উপজেলায় তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে পানি হু হু করে প্রবেশ করছে। তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। দেখা দিয়েছে ভাঙন। এ ছাড়া তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। ৪৪টি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব আরো জানান, এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীগুলোর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এরই মধ্যে তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এই সময়ে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম জেলার এসব নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরেজমিন পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলে পানি উঠছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে এ রকম পরিস্থিতিতে এই ৫ জেলার চরাঞ্চলের ২২৫টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্রায় ২ লাখ মানুষ প্লাবিত হয়।

ইতোমধ্যেই তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। চরাঞ্চল এবং নি¤œাঞ্চলগুলো থেকে মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে চলে যাচ্ছেন।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের রাস্তা, ব্রিজ ভেঙে চরসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। পানিবন্দী পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গরু, ছাগল, হাস-মুরগী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের দেয়া ও শুকনো খাবারই একমাত্র ভরসা পানিবন্দীদের। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। টয়লেট করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পানি বাড়া-কমার সাথে সাথে চলছে অববাহিকাগুলো জুড়ে ব্যাপক ভাঙন। তিস্তা, ধরলাসহ এই অঞ্চলের অববাহিকাগুলের অন্তত ১০৮টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ছোটবড় ভাঙন। অনেকস্থানে ভাঙন ঠেকানোর কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

পাউবো উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি স্থাপনা থাকলে গুরুত্ব দিয়ে সেসব স্থানে আপৎকালীন কাজ করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারাক্ষণ নদী পাড় মনিটরিং করছেন।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই অঞ্চলের তিস্তা পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অন্যান্য জেলাগুলোর নদ নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রকল্প কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সব প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা পানিবন্দী হয়ে পড়বেন তাদের দ্রুতগতিতে উঁচু স্থানে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন তারা। পানিবন্দী মানুষের তাৎক্ষণিকভাবে খাবারও দেয়ার ব্যবস্থা করবেন তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি ঢল এবং ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যা দেখা দেবে এই অঞ্চলে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, তৃতীয় দফায় লালমনিরহাট জেলার তিস্তার বাম তীরের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে।

গতকাল বেলা ৩টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি সমতল রেকর্ড করা হয় ৫২.১৯ মিটার, যা বিপদসীমার ৪ সেমি. ওপরে। একই দিনে সকাল ৬টায় তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি সমতল রেকর্ড করা হয় ৫২.২২ মিটার, যা বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গেল সপ্তাহে বিপদসীমা অতিক্রম করে নদীর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। একদিন পানি কমলেও গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় তা আবার বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

গতকাল সকালে পানি আরো বেড়ে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুর ৩টায় ৫২.১৯ মিটার, যা বিপদসীমার ৪ সেমি. ওপরে। ফলে তিস্তা নদীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নদীপাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

নদীপাড়ের মানুষ ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি এবং উজানের পাহাড়ি ঢলে গত সোমবার রাত থেকে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে থাকে।

জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, পলাশী এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

পানি প্রবাহ যত বাড়বে বন্যার শঙ্কা ততই বাড়বে। এতে তিস্তার বাম তীরের লালমনিরহাটে তৃতীয় দফায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানির চাপের কারণে বেশ কিছু রাস্তা ও বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ভোটমারীতে ইস্ট্রাকো সোলার প্যানেল এলাকা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। এ স্থানে তিস্তা নদীর মূলস্রোত ধারা বন্ধ করে সোলার প্যানেল স্থাপন করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করতে রাস্তাগুলোতে চাপ পড়েছে। এটি ভেঙে গেলে নদী চলে আসবে কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে।

স্থানীয় বাসিন্দা সামসুল আলম বলেন, সোলার প্যানেলের কারণে পানির চাপ পড়ছে লোকালয়ের রাস্তা ও বাঁধে। এগুলো রক্ষা করা না হলে হাজার হাজার বসতভিটা আর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হবে। তখন নদী এসে পৌঁছাবে উপজেলা শহরে।

ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই আমার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের দেড় হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। বাঁধগুলো সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, ভারী বৃষ্টিপাতে ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১৫টি চরসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ওই সব গ্রামের মানুষজন তিস্তার পানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।

ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) হাফিজুর রহমান জানান, তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় এই ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন জানান, খগাখড়িবাড়ী বাইশপুকুর গ্রামটিতে বানের পানি প্রবেশ করতে শুরু করায় ওই গ্রামের মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা জানান, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত এক সপ্তাহে নদীতে পানি বেড়েছে প্রায় ১৫০ সেন্টিমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, পদ্মার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ধারাবাহিক পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষেত। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর এই দুই ইউনিয়ন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইউনিয়ন দু’টিতে অবস্থিত প্রায় ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। পদ্মার পাড় পেরিয়ে পানি যেন লোকালয়ে প্রবেশ না করে সে জন্য পূর্ব থেকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি এলাকাবাসীর।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ভারতে থেকে ফারাক্কা হয়ে পানি পদ্মায় পড়ছে। গত ২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল বুধবার সকালে উপজেলার ভাগজোত পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ১৪.৭২ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টের বিপদসীমা হলো ১৫.৭০ সেন্টিমিটার। সে অনুযায়ী বিপদসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার (০.৯৮ মিটার) নিচ দিয়ে পানি প্রবাহি হচ্ছিল।

গত মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, পদ্মা নদীতে প্রতিদিন হু হু করে পানি বাড়ছে। দুই দিন আগেও যেসব এলাকা শুকনা ছিল। এখন সেখানে বন্যার পানিতে থই থই করছে। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ইউনিয়ন দু’টি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দু-এক দিনের মধ্যেই এসব গ্রামের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ দিকে ফিলিপনগর, মরিচা, চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর চরাঞ্চলের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির মরিচ, কলা, ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষেতে পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, রাস্তাঘাটে পানি ঢুকে পড়ায় চিলমারী ইউনিয়ন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যেকোনো সময় চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে যেতে পারে।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুশতাক আহম্মেদ বলেন, বন্যা কবলিত এলাকায় পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ১৮টি বিদ্যালয়ের শ্রেণী পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বিদ্যালয়গুলো খোলা থাকবে যাতে বন্যাকবলিত মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, চরাঞ্চলের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির মরিচ, রোপা আউশ, কলা, বিভিন্ন ধরনের সবজি, ভুট্টা বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে এখনো যেসব জমিতে পানি প্রবেশ করেনি সেগুলোও আক্রান্ত বা তলিয়ে যেতে পারে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হাই সিদ্দিকী বলেন, পদ্মায় পানি বেড়ে যাওয়ায় উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া, শুকনো খাবারসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।