পরিচয়বিহীন অভিযোগে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ অচলপ্রায়

বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অপকর্মের হোতা বা চক্রের পক্ষ থেকে কাজ করছেন কল্পিত আব্দুল হান্নান। তিনি যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন তাতে নিজের কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানা নেই। আর এই ভুতুড়ে অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমকে এক জটিল পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে চলতি বছরের ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী পরিচয়ে মো: আব্দুল হান্নান নামে এক ব্যক্তি শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু কে এই আব্দুল হান্নান তা বের করতে পারলে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। আদতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অপকর্মের হোতা বা চক্রের পক্ষ থেকে কাজ করছেন কল্পিত আব্দুল হান্নান। তিনি যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন তাতে নিজের কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানা নেই। আর এই ভুতুড়ে অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমকে এক জটিল পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

‘ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নজিরবিহীন দলীয়করণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিতকরণ, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ শীর্ষক তিন পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে অভিযোগকারীর কোনো পূর্ণ পরিচয়, ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর নেই। চিঠিতে ভিসি অধ্যাপক ড. মো: শামছুল আলম, কামিল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ অলী উল্যাহ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আলীসহ বেশ কয়েকজনের নাম জড়িয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়। তবে বেনামি ওই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করেই জরুরি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব এ কে এম তাজকির-উজ-জামান। সে অনুযায়ী অভিযোগটি আমলে নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব নাঈমা খন্দকার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয় ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর। এতে বলা হয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে আনীত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তদন্তপূর্বক সুপারিশসহ মতামত দেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

অথচ বেনামি বা নামবিহীন দরখাস্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে পরিপত্রে নির্দেশ দেয়া আছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে হয়রানি করা ও প্রশাসনিক কাজে অহেতুক জটিলতা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই এ ধরনের দরখাস্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য। এ ধরনের দরখাস্তের ওপর ভিত্তি করে কোনো অনুসন্ধান বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় যাবে না।

এদিকে গত ১১ সেপ্টেম্বর ইউজিসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত চিঠি মারফত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আব্দুর রশীদ ও প্রোভিসি মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে মাদরাসা পরিদর্শন অধিভুক্তি, প্রাথমিক পাঠদান অনুমোদন এবং নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য ঘুষ দাবির বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে কমিশনকে অনুরোধ করা হয়। সেই সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় জনবল নিয়োগে অনিয়মসংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হলে এ বিষয়ে কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিতর্ক এড়াতে বিজ্ঞপ্তি দেয়া সব পদের জনবল নিয়োগ আপাতত স্থগিতের জন্য অনুরোধ করা হলো।

সূত্র মতে, সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আব্দুর রশীদ ও প্রোভিসি মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের দুর্নীতি তদন্তে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো: সাইদুর রহমানকে আহ্বায়ক করে প্রথমে ১৮ আগস্ট তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ফ্যাসিবাদী দোসরদের বিতর্কিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি পুনর্গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আবুল কালাম সরকারকে আহ্বায়ক করা হয়। এ ছাড়া কমিটির টার্মস অব রেফারেন্সে আগের ভিসি ও প্রোভিসি দুর্নীতির পাশাপাশি সাম্প্রতিক অভিযোগগুলোও যুক্ত করা হয়।

আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এসব বিষয় ইউজিসি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তা ছাড়া ইউজিসির সদস্যকে বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এবং টার্ম অব রেফারেন্সে পরিবর্তন আনার কারণে আগের দুর্নীতির তদন্ত শেষ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এভাবে একাধিক তদন্ত কমিটি ও চিঠি চালাচালির জটিল আবর্তে আটকে পড়েছে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী দুঃশাসনে অবহেলিত ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। দলীয়করণের কারণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যোগ্যদের পরিবর্তে আওয়ামীপন্থী ও তাদের অনুগতদের নিয়োগ, শীর্ষ থেকে নিম্নপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপক অনিয়ম, সরকারি বাজেট বরাদ্দ না দেয়া, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে অনেকটা গতিহীন হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে উপাচার্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন এনে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হলেও তারা বেনামি অভিযোগ ও তদন্তের মারপ্যাঁচে পড়ে তাদের নানামুখী পরিকল্পনা আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টায় আওয়ামী সুবিধাভোগী, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানা অপতৎপরতা এখনো চলছে। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে সে ষড়যন্ত্র এতদিন সফল হয়নি। তবে এক বছরের মাথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আওয়ামী দোসর ও সুবিধাভোগীরা নতুন করে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের নানা চক্রান্তে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে বেশকিছু পদে জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে একটি মহল।