‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ - ২০২৫’

ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে গ্রাহকরা পাবেন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

  • ক্ষতিপূরণ ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ করা হয়েছে
  • ১ম বারের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এ অধ্যাদেশের আওতায়

কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা অবসায়ন হলে গ্রাহকরা তার আমানতের বিপরীতে পাবেন মাত্র দুই লাখ টাকা। এ অর্থ তাদেরকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে দেয়া হবে। এ নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করে সরকার ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। এটি আবার অধ্যাদেশ আকারে অনুমোদনও করা হয়েছে।

বলা হয়েছে,আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং এ খাতের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াতে ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’টি করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশটি বিদ্যমান ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন ২০০০’ স্থলাভুক্ত হবে। পুরনো আইনে কোনো ব্যাংক বন্ধ হলে গ্রাহকরা পেতেন সর্ব্বোচ্চ এক লাখ টাকা। তাও এ অর্থ তাদের দেয়া হতো ১৮০ দিনের মধ্যে। তবে ব্যাংক আমানত বীমা আইনে ব্যাংক বহির্র্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে গ্রাহকরা কত ক্ষতিপূরণ পাবেন তার কোনো উল্লেখ ছিল না। নতুন অধ্যাদেশে ব্যাংকবহির্র্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদেরও সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। তারা ব্যাংকের গ্রাহকের মতো একই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবেন।

জানা গেছে, নতুন এ অধ্যাদেশে সকল ব্যাংক আওতাভুক্ত থাকলেও এখুনি এর আওতায় আসছে না ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অধ্যাদেশের আওতায় আসতে তাদের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে আগামী ২০২৮ সালের জুলাই পর্যন্ত। সংশোধিত অধ্যাদেশে ৬টি অধ্যায় ও ৩৩টি ধারা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

নতুন এ অধ্যাদেশে আমানত সুরক্ষায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আগে শুধু ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য ছিল এবং সুরক্ষিত আমানতের পরিমাণ এক লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সুরক্ষিত আমানত পরিশোধের সময়সীমা ১৮০ দিনের পরিবর্তে ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমার বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এতে প্রায় ৯৩ শতাংশ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। প্রতি তিন বছরে একবার এ সুরক্ষা সীমা পর্যালোচনা করা হবে।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক আমানতকারীদের সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে ‘ব্যাংক ডিপোজিট ইন্সুরেন্স অর্ডিনেন্স, ১৯৮৪’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে উক্ত অধ্যাদেশটি রহিত করে বাংলায় ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০’ প্রণয়ন করা হয়। বিদ্যমান এ আইনের আওতায় তফসিলি ব্যাংকসমূহের নিকট থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে ‘আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল’ গঠনপূর্বক শুধু তফসিলি ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিধান করা হয়।

তফসিলি ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ফাইন্যান্স কোম্পানি জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে- যেসব আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি বিদ্যমান আইনে আওতাভুক্ত করা হয়নি। ফলে বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে এতদিন ফাইন্যান্স কোম্পানিসমূহের আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষা করা সম্ভব হতো না। এ ছাড়া, বিদ্যমান আইনে সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমা এক লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন এবং এর পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করার সুযোগও বিদ্যমান আইনে নেই।

এ পরিপ্রেক্ষিতে, ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০’কে অধিকতর যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পরিমার্জনপূর্বক ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক উত্তমচর্চা অনুশীলনের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের (আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক) পরামর্শ গ্রহণ করা হয়।

সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমার বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এতে প্রায় ৯৩ শতাংশ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। প্রতি তিন বছরে একবার এ সুরক্ষা সীমা পর্যালোচনা করা হবে।

সংশোধিত অধ্যাদেশে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক ‘আমানত সুরক্ষা তহবিল’ গঠন করা হবে। এ তহবিল দু’টি পরস্পর বিনিমিয়যোগ্য হবে না এবং পরস্পরের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করতে পারবে না। তহবিল পরিচালনা ও প্রশাসনের জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড থাকবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এ তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ড হবে। তবে তহবিলটি অন্যান্য তহবিল থেকে স্বতন্ত্র হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় ও সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। তহবিল পরিচালনায় ‘আমানত সুরক্ষা বিভাগ’ নামে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করা হবে এবং এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র হবে।

অধ্যাদেশ জারির পর বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমানত সুরক্ষা তহবিল-এর সদস্য হিসেবে গণ্য হবে। কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হলে সেটিও আইন অনুযায়ী তহবিলের সদস্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে লাইসেন্স প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যে প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম জমা দিতে হবে।

অন্য দিকে বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্তরা ২০২৮ সালের ১ জুলাই এ আইনের আওতায় তহবিলের সদস্য হবে এবং ওই বছর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম জমা দেবে।

নতুন অধ্যাদেশে প্রিমিয়াম হারের পরিমাণ হচ্ছে পরিশোধিত মূলধনের দশমিক ৫০ শতাংশ বা ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ। তবে এটি পরিশোধিত মূলধনের দশমিক ৫০ শতাংতের কম হবে না। সংশোধিত অধ্যাদেশে আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রেজুুলেশনের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিধানের আলোকে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াধীনে থাকা পাঁচটি শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের সুরক্ষায় ১২ হাজার কোটি টাকা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া এ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক মুনাফার চেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র, বৈচিত্র্য ও তহবিলের তারল্য সংরক্ষণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়।