বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন দেশের ইসলামী দলগুলোর নেতারা। তারা মনে করেন এ সরকার যদি এখনই জুলাই সনদের স্বীকৃতি না দেয় তাহলে পরবর্তীতে এটি আর বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ জন্য এখনই তারা এটির বাস্তবায়ন চান। এ ছাড়া পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আয়োজনের দাবিতেও তারা অনড়। এ দু’টি দাবি বাস্তবায়ন না হলে তারা আন্দোলনে নামবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা শুরু থেকেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ দু’টি ছাড়াও সাত দফা দাবিতে আজ থেকে মাঠে নামছে দলটি। বিকেলে বিজয়নগর পানির ট্যাংকি এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে তারা। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের পর এক প্রতিক্রিয়ায় দলটির এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান আকাংক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এ জন্য ছয়টি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে দু’পর্বের দুই মাসেরও অধিক কাল যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই। ঘোষণায় কখন কিভাবে তা কার্যকর করা হবে তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোট এর মাধ্যমে আইনি ভিত্তি প্রদান করা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রসঙ্গে গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, পিআর পদ্ধতি হচ্ছে একটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা। যে পদ্ধতিতে প্রতিটি দলের সারাদেশে পাওয়া মোট ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হবে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে আন্দোলনে নামার কথা তুলে ধরে ডা: তাহের বলেন, সংসদে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। কিন্তু আমাদের দাবি হচ্ছে পিআর হতে হবে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে। সেই ইস্যুতে আমরা আন্দোলন করবো। কারণ হচ্ছে, ৫৪ বছরের নির্বাচনের পদ্ধতিতে আমরা দেখেছি এখানে ফেয়ার ইলেকশন কখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
এ দিকে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমান সরকার যদি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দেয় তাহলে আগামী সরকার এসে এটা করবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ জন্য আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে এটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছি। গণভোট বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স) নিয়ে করা যেতে পারে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, মূলত জুলাই আন্দোলন হয়েছে আগামীতে যাতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। এ জন্যই এত রক্ত ঝরেছে, মানুষ জীবন দিয়েছে, আহত, পঙ্গুত্ববরণ করেছে। কিন্তু তার যদি কোন পরিবর্তন না হয়, আগের মতোই যদি কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপি করার সুযোগ থেকে যায় তাহলে কী লাভ হলো? এ জন্য এবার আমরা কমপক্ষে উচ্চকক্ষে ও নারীদের ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলেছি। এ ব্যাপারে সরকার যদি অন্য কোনো চিন্তা করে তাহলে আমরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করে নির্বাচন করবে- এটাই ছিল দাবি। এ জন্যই আমরা এ সরকারকে সমর্থন করেছি। এ সরকারের আমলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে দেশে আগের মতোই কর্তৃত্ববাদী শাসন চলবে। এই সরকারকেই জুলাই ঘোষণা ও সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের এত মিটিং, এত আয়োজন করে কী লাভ হলো? কোনো একটি দলের খেয়াল খুশি মতো তো দেশ চলতে পারে না। মানুষ পরিবর্তন চায়। আমরাদেরও এটি মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা আন্দোলন করব। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের এ মুখপাত্র বলেন, অতীতে নির্বাচন নিয়েই মূল সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ জন্য আমরা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের কথা বলেছি। সরকার একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমরা মেনে নেবো না। অন্তর্বর্তী সরকার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না দিলে আমরা জনমত গঠনে মাঠে নামব। আন্দোলন করব।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র দিয়েছে। এ ছাড়া আমরা জুলাই সনদের কথা বলেছি। অবশ্যই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি তৈরি করতে হবে। বর্তমান সরকার আমাদের জানিয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এটি দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এটি আমরা মানতে পারি না। কারণ তাহলে এ সরকারের কাজটা কী? আমাদের স্পষ্ট অবস্থান-বর্তমান সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, সরকার উচ্চকক্ষে বাস্তবায়নের কথা বলেছে; কিন্তু সেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তার মানে তারা এটি মানে না। তাহলে তারা নির্বাচনে বিজয়ী সরকার গঠন করলে তারা এটি বাস্তবায়ন করবে না। এ জন্য আমরা সরকারকে বলব তাদের চেষ্টা করে এ নোট অব ডিসেন্ট পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া আমরা নিম্নকক্ষে ৩০০ আসনে বর্তমান পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে দাবি জানিয়েছি। তাহলে উচ্চকক্ষে আনুপাতিক হারে সব দলের প্রতিনিধি থাকবে। এসব যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে আমরা সমমনা দলগুলোর সাথে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুফতি মুসা বিন ইজহার নয়া দিগন্তকে বলেন, অন্তবর্তী সরকারকেই জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। নতুন সরকার এসে এটা করবে এমন কোনো নিশ্চয়তা আমরা পাচ্ছি না। কারণ বিএনপি আগেই বলে দিয়েছে তারা করবে না। এ জন্য এ সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে আমরা আন্দোলনে নামব। পিআর পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, আমরা দু’কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। সরকার উচ্চকক্ষের ব্যাপারে ইতোমধ্যে পিআর পদ্ধতির প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিম্নকক্ষেও আমরা পিআর চায়। সরকার এটি বাস্তবায়ন না করলে পরবর্তী পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এ ছাড়া অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, জুলাই সনদে সরকার শাপলা গণহত্যা, ২১ সালের মোদি বিরোধী আন্দোলন, ’৪৭-এর আন্দোলন ও ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে সেনাসদস্যদের হত্যার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। বিশেষ করে শাপলা চত্বরের প্রতিবাদ ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা। এটি অস্বীকার করা মানে ইতিহাস বিকৃতি। সরকারের ভেতরের ভারতপন্থীদের মধ্যে দীর্ঘ দিনের যে ইসলামবিদ্বেষ ও ভারত প্রেম রয়েছে তার প্রতিফলন এটি। ইসলামপন্থিদের দমিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবেই এটি করা হয়েছে। এ জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টাকেই দায়ী করব।