বরিশালে ৫০০ বছরের গজনীর দীঘি, রয়েছে পর্যটন সম্ভাবনা

প্রশাসন দ্রুত এই দীঘিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের আওতায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন স্পট হিসেবে ঘোষণা করবে- এমনটিই প্রত্যাশা বরিশালবাসীর।

খালিদ সাইফুল্লাহ, বরিশাল ব্যুরো
Printed Edition
বরিশালে ৫০০ বছরের গজনীর দীঘি, রয়েছে পর্যটন সম্ভাবনা
বরিশালে ৫০০ বছরের গজনীর দীঘি, রয়েছে পর্যটন সম্ভাবনা

প্রায় ৪৭০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক গজনীর দীঘি। যেখানে রয়েছে পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কিন্তু দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক এ স্থানটি পড়ে রয়েছে অবহেলা আর অযতেœর মাঝে। সরকারের সুদৃষ্টি পেলে এটি হতে পারে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উৎস। আর বরিশালবাসীসহ দেশের মানুষের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র। বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের চাঁনপুরা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক গজনীর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে স্থানীয় মানুষের নানা কৌতূহল। প্রশাসন দ্রুত এই দীঘিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের আওতায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন স্পট হিসেবে ঘোষণা করবে- এমনটিই প্রত্যাশা বরিশালবাসীর। সেই সাথে দীঘির চারপাশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ ও উন্নত সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করাও দাবি তাদের।

স্থানীয়দের মতে, বৈরম খাঁর খনন করা এবং সুফিসাধক গজনী শাহের স্মৃতিবিজড়িত এই দীঘি শুধু একটি প্রাচীন জলাশয় নয়, বরং এটি বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। অথচ অব্যবস্থাপনা, অবৈধ দখল ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এই ঐতিহ্য ধ্বংসের মুখে। বরিশাল নদীবন্দর পার হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে বৈরাগীর বাড়ির পুলের বাম দিকে নেহালগঞ্জ সড়কের দুই কিলোমিটার ডান দিকে ধোপা বাড়ির সামনে গজনীর দীঘি। আর দীঘির পশ্চিম পাড়ে রয়েছে বাতাস ফকিরের মাজার। সেখানে বড় আকারে বার্ষিক অনুষ্ঠানসহ প্রতিদিনই যাতায়াত থাকে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। কিন্তু ধোপা বাড়ির সম্মুখে গজনীর দীঘি পর্যন্ত আধা কিলোমিটার সড়কটি যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হাকিম অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে কতিপয় লোক এই দীঘিকে দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। কেউ নিজেদের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করছেন, কেউ আবার মামলা দিয়ে সরকারি মালিকানায় জটিলতা সৃষ্টি করছেন। এমনকি দীঘির পশ্চিম উত্তর পাড়ে বসতবাড়ি নির্মাণ করে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। মো: কবির নামের অপর একজন বলেন, গত ১৭ বছরে এখানে প্রায় ২০-২৫টি বসতি গড়ে উঠেছে। এদের প্রত্যেকেই অন্য এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও শুধু ভূমি দখলের জন্যই এখানে বসতি গেড়ে বসেছেন।

ইতিহাস বলছে, মুঘল সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরম খাঁ ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে এটি খনন করেন। তৎকালীন সময়ে ইসলাম প্রচারের জন্য চাঁদপুরায় বসতি স্থাপন করেছিলেন সুফিসাধক গজনী শাহ, যিনি দীঘির পাড়ে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তার নামেই দিঘির পরিচিতি হয়। ২৫ একর জমির ওপর রয়েছে এই গজনীর দীঘি। এর ১১ দশমিক ৭০ একর জমির ওপর দীঘির পানি। বিশুদ্ধ পানির জন্য মুঘলরা এই দীঘি খনন করেছিলেন বলে জানা গেছে। কয়েক হাজার শ্রমিক দীর্ঘ সময় ধরে খনন করেন এটি। দীঘিটির পাড় ছিল অনেক উচ্চতায়। যেখানে সাধারণ মানুষও উঠতে ভয় পেত। বর্তমানেও এই দীঘির পাড় ২৫-৩০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে। স্বাধীনতার পরও এখানে জমকালো গজনীর মেলা বসত, যেখানে ঘোড়দৌড়সহ নানা আয়োজন হতো। কিন্তু ১৯৯১ সালে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এক হত্যাকাণ্ডের পর সেই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৭৭ সালে এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে জোট সরকারের সময় ২০০৬ সালে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সাহায্য সংস্থা এই দীঘির ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে আবার মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসে। তবে দীর্ঘ সময়ে এটি পরিত্যক্ত থাকায় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভূমিদস্যুদের দিয়ে দখল বাণিজ্য শুরু করে।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল শরিফ বলেন, প্রতি বছর এখানে গজনী মেলা বসত, কিন্তু এখন দীঘির চার পাশে দখলদারিত্ব আর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এর ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শাহজাহান মল্লিকের অভিযোগ, দীঘির দক্ষিণ ও পূর্বপাড় দখল হয়ে গেছে। পূর্ব ও দক্ষিণ প্রশস্ত পাড়ের ওপরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৭টি বসতঘর। কেউ খেয়াল রাখছে না। যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হয়, ঐতিহ্যটা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমান জানান, দীর্ঘ দিন অযত্ন, অবহেলায় পরে আছে দীঘিটি, এখন এটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কেউ দীঘির পার দখল করে থাকলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে এটিই স্বাভাবিক।

চাঁদপুরার বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান এইচ এম জাহিদ জানান, দুই বছর আগে দর্শনার্থীদের বসার জন্য সরকারি অর্থায়নে ২০টি বেঞ্চ বসিয়েছি এবং দীঘির দক্ষিণ পাশের সড়কটিও পিচ ঢালাই করাসহ পশ্চিম পাশে বাতাস ফকিরের মাজারের সম্মুখে একটি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, যারা দীঘির পাড়ের উপরে ১৫-২০ বছরের মধ্যে বসতি গড়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভিটেবাড়ি ও জমাজমি রয়েছে; তারা কেউই ভূমিহীন নয়।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ও স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন বলেন, এই দীঘি আওয়ামী লীগের ভূমিদস্যু দখলদারদের হাত থেকে দ্রুত রক্ষা করা দরকার। দীঘির পারগুলো থেকে গাছ কাটাসহ বসতবাড়ি গড়ে তুলে এখন পুরো দীঘি দখলের পাঁয়তারা করে আসছে। এ জন্য যথাযথ প্রশাসন যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করছি। তা না হলে দখলদারদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করব।

বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কাস্টোডিয়ান আরিফুর রহমান বলেন, চাঁদপুরা ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শ’ বছরের প্রাচীন গজনীর দীঘি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এ দীঘি শুধু অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে না, বরং সঠিক সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ইকবাল হাসান জানান, আমরা জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ঐতিহাসিক যত স্থাপনা ও ঐতিহ্য আছে সেগুলোকে তুলে ধরতে চাই। পর্যটন ও ইতিহাসের সমন্বয়ে গজনীর দিঘিকে সাজাতে চাই। দীঘিটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পরে সম্প্রতি দুই বছরের জন্য মাছ চাষের জন্য দীঘিটি লিজ দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের জন্য দীঘির উত্তর ও দক্ষিণ পারে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ বসানো হয়েছে। দীঘির দু’টি জানের ওপর পানিপ্রবাহের জন্য দু’টি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। জেলা প্রশাসক খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শনে যাবেন বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। বরিশাল জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘স্থানটির কথা শুনেছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমি পরিদর্শনে যাবো এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব।’