সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র বিশ্লেষক সাকিব আলী বলেছেন, সম্পদের লুণ্ঠন এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে এটা আর মানা যাচ্ছে না। অলিগার্ক যারা উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক তারা শুধু শক্তি দিয়ে আধিপত্য বিরাজ করে না। এ জন্য তারা মিডিয়াকে হাত করে, তাদের রিলিজিয়ন কাজ করে, তাদের এডুকেশন কাজ করে। সাংবাদিক, শিক, ধর্মযাজকদেরকেও তারা কোঅপ্ট করে। তাই দুর্নীতির পতন ছাড়া মুক্তির পথ নেই।
দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে সাকিব আলী এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন নয়া দিগন্তের বিশেষ সংবাদদাতা রাশিদুল ইসলাম ও হেড অব ডিজিটাল মোস্তাফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে মূল অংশটা তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়া কি এখন জেনারেশন জেডের চারণভূমি হয়ে উঠছে?
সাকিব আলী : আরব বসন্তের মতো সরকার পতন হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এর নিজস্ব রূপ আছে। আরব বসন্তের সময়ে ইউরোপের ঔপনিবেশিক প্রভাব ছিল, পরে যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শক্তি ভারত। এই পাওয়ার ডাইনামিক্সের সাথে গণ-অভ্যুত্থানের সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন : কর্তৃত্ববাদী শাসন কি এসব দেশে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে?
সাকিব আলী : হ্যাঁ। পূর্বের প্রজন্ম কর্তৃত্ববাদ মানলেও নতুন প্রজন্ম তা মানেনি। সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ছিল বাংলাদেশে, যা নিহতের সংখ্যাতেও বোঝা যায়। নেপালে ২০ জন নিহত হওয়ার পরই সরকার পড়ে যায়। শ্রীলঙ্কায়ও কিছুটা সময় লেগেছে।
প্রশ্ন : তরুণদের গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে দুর্নীতি কতটা ভূমিকা রেখেছে?
সাকিব আলী : দেশভেদে দুর্নীতির রূপ ভিন্ন। এখন সামাজিক মাধ্যমে এক্সেস ও বিলাসী প্রদর্শন মানুষের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। হাসিনা সরকারের সময় এ ধরনের প্রদর্শন প্রকট ছিল। ফলে দুর্নীতি ও শোষণ তরুণদের সামনে নগ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে।
প্রশ্ন : শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বাংলাদেশ ও নেপালে এ সঙ্কট কাটবে কিভাবে?
সাকিব আলী : তিন দেশই সঠিক পথে আছে। শেখ হাসিনার সময়ে জনগণের প্রধান অভিযোগ ছিল দুর্নীতি। এখন স্বৈরাচারী সরকারকে হটানো হয়েছে। যদিও আমাদের পথ মসৃণ নয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বা পরবর্তী সরকারকেই এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

প্রশ্ন : ছাত্রদের আন্দোলনের পর এখন কি পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া জরুরি নয়?
সাকিব আলী : দুটোই করতে হবে- শিক্ষা, চরিত্র গঠন ও সংগ্রাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। তবে ছাত্ররা যেন লেজুড়বৃত্তি ও দুর্নীতিতে না জড়ায় সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন : ছাত্রদের গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাব কি গণমানুষের মনে থাকবে?
সাকিব আলী : অবশ্যই। ছাত্র রাজনীতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারব না। বরং দলীয় রাজনীতি কমলে চিন্তাশীল ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য গড়ে উঠতে পারে। ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ফলাফলই তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রশ্ন : ভারত অভিযোগ করছে বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটছে। আপনার মন্তব্য?
সাকিব আলী : আমি এই অভিযোগ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছি। ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা থাকলেই ভারত রিঅ্যাক্ট করে, কিন্তু হিন্দুত্ববাদকে তারা উগ্রবাদ বলে না। কোনো ধর্মেই অন্যায় বা উগ্রবাদের স্থান নেই। এই অভিযোগ কেবল প্রপাগান্ডা।
প্রশ্ন : ভারতের অভ্যন্তরে কি জেনারেশন জেড আন্দোলনের সম্ভাবনা আছে?
সাকিব আলী : কর্তৃত্ববাদ বা দুর্নীতি থাকলেও ভারত এখনো ঐক্যবদ্ধ জনগণের দেশ। কাস্ট পলিটিক্স ও বিভাজন জেন জেডকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেবে কি না তা প্রশ্ন। তবে প্রতিবেশী আন্দোলন তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।
প্রশ্ন : জেনারেশন জেডের উত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে?
সাকিব আলী : আমরা বড় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছি। নলেজ বেজড বিপ্লব, প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও স্বচ্ছ হতে বাধ্য করবে। দুর্নীতিবিরোধী এই আন্দোলন বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মিকতার দ্বন্দ্বেরও অংশ।
প্রশ্ন : তরুণদের পরিবর্তনের চাপ কি রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করছে?
সাকিব আলী : মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন রাজনৈতিকদলগুলো সহজে নিতে পারে না। যে দল মানাতে পারে না, তার পতন হয়; নতুন দল উঠে আসে। বিএনপি এখন ট্রাবলে পড়েছে, জামায়াতের এ সমস্যা নেই।

প্রশ্ন : বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা জিয়াউর রহমানের ভিশন কি বিএনপি অনুসরণ করতে পারছে?
সাকিব আলী : না। জিয়াউর রহমান শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষদের রাজনীতিতে এনেছিলেন, ছাত্ররাজনীতিকে অন্যভাবে দেখেছিলেন। পরবর্তী নেতৃত্ব ওই ভিশন মেইনটেইন করেনি, ফলে দলীয় দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে।
প্রশ্ন : সারা বিশ্বে যে অস্থিরতা চলছে, জেন জেডের উত্থান কি তা প্রশমিত করতে পারে?
সাকিব আলী : পারে। এই প্রজন্ম বস্তুবাদের বিরুদ্ধে, পরিবেশ ও নৈতিকতার পক্ষে। আগামী ২০ বছরে পুঁজিবাদ টিকবে না। যেমন আইসবার্গ ভাঙছে, তেমনি পরিবর্তন আসছে।
প্রশ্ন : এই সন্ধিক্ষণে আমাদের এগোনোর পথ কী?
সাকিব আলী : দুইটা পথ। দুর্নীতি আর নৈতিকতা। দুর্নীতির পথে যারা আছেন তারা নৈতিকতার পথ আটকাবে এটাই স্বাভাবিক। মার্ক্সের ভাষায় যারা উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক তারা কখনো দুর্নীতিগ্রস্ততা থেকে মানুষকে বের হতে দেবে না। তাদের পতন ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব না। আশির দশকে রোনাল্ড রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচারের শাসনামল থেকে প্রাচুর্যের জয় শুরু হয়েছে। গরিবের দমন-পীড়ন আর ধনীর বিজয়। সম্পদের লুণ্ঠন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে এটা আর মানা যাচ্ছে না। উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক অলিগার্করা শুধু শক্তি দিয়ে আধিপত্য বজায় রাখে না। এ জন্য তারা মিডিয়াকে হাত করে, তারা রিলিজিয়নকে এডুকেশনকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। তাদের কাছ থেকে মুক্তির এই সংগ্রাম শুধু রাস্তায় নয়, সংস্কৃতিতেও আছে। দুর্নীতির পতন ছাড়া দেশের, জনগণের মুক্তি নেই।