জুলাই হত্যাকাণ্ডে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

আলমগীর কবির
Printed Edition

মানবতাবিরোধী অপরাধ

  • আসাদুজ্জামান খান কামালেরও সর্বোচ্চ শাস্তি
  • রাজসাক্ষী মামুনের ৫ বছরের কারাদণ্ড

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া একই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মামলার অন্যতম আসামি ও রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ছয় অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারক মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলের অপর সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ। দুই ঘণ্টা ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে বেলা ২টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। মূল রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদার।

রায় প্রসঙ্গে পরে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো: তাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, দু’টি চার্জে ভাগ করে আসামিদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চার্জে ছিল গণভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের সাথে কথোপকথন এবং রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার বিষয়টি। দ্বিতীয় চার্জে ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সাথে শেখ হাসিনার কথোপকথনের সময় ড্রোন হামলার নির্দেশনা, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়া ও সাভারে ছয়জনকে হত্যা।

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এগুলোর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন পাঁচটি অভিযোগ আলাদা ভাগ করে সাজা প্রদান করা হয়েছে আসামিদের। তাদের বিরুদ্ধে গঠন করা প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে উল্লেখ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী’ ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। প্ররোচনা, উসকানি, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে এতে। এই অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তিনি অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ‘ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ’ অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন।

তিনটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ দিয়েছেন। চার নম্বর অভিযোগে, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। পাঁচ নম্বর অভিযোগ আশুলিয়াতে জীবিত একজনসহ মোট ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে গঠন করা হয়েছে।

এছাড়া ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়াতে জীবিত একজনসহ ছয়জনকে পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে, এই মামলার একমাত্র গ্রেফতার আসামি ও ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে প্রথম অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অপরাধের ব্যাপকতা এবং যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেসব অপরাধ তিনি করেছেন সেগুলোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির যোগ্য। কিন্তু যেহেতু তিনি এই মামলাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাহায্য করেছেন সে বিষয় বিবেচনায় তিনি ন্যূনতম সাজা পাবেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরো বলেছেন, তিনি সব অ্যাট্রোসিটিজের জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনার বিবরণ পূর্ণাঙ্গভাবে ডিসক্লোজ করেছেন তিনি। এসব বিষয় বিবেচনায় সাবেক এই আইজিপিকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

দোর্দণ্ড প্রতাপে দেড় দশক দেশ শাসন করা হাসিনা ১৫ মাস আগের ওই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে এখন পালিয়ে আছেন ভারতে। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সাবেক সরকারপ্রধান, যার মাথার ওপর ঝুললো মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া।

আর সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেই শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার রায় এলো, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল। এই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় এলো তার বিয়েবার্ষিকীর দিনে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। মামলার আসামিদের মধ্যে হাসিনার মতো কামালও ভারতে পালিয়ে আছেন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন কেবল সাবেক আইজিপি মামুন।

রায়ের জন্য এদিন সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে।

সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফার রূপ নেয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে; পালিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর তার বিরুদ্ধে কয়েক শ’ মামলা হয় দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায়। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। ফলে তার রায়ের দিনে পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন এ রায়ের প্রভাব যে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কার কী প্রতিক্রিয়া : জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার ও আহতরা গতকাল ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের সামনে এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ‘এই মাত্র খবর এল, খুনি হাসিনার ফাঁসি হল’ সেøাগান দিতে দিতে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।

ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা মনে করি এই রায়টি কোনো ধরনের অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি হচ্ছে জাতির প্রতিজ্ঞা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা হচ্ছে জাতির কোয়েস্ট ফর জাস্টিস।’ তিনি বলেন, এই রায় প্রমাণ করেছে- অপরাধী যত বড়ই হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এবং বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে। তাজুল বলেন, বাংলাদেশে যে ১৪০০ তরতাজা তরুণ এই স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবারে যদি সামান্য একটু স্বস্তি আসে, সেটিই আজকের এই প্রসিকিউশনের প্রাপ্তি। জাতির পক্ষে আমরা একটা বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার মাধ্যমে এই জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার আমাদের যে ক্ষুদ্র প্রয়াস, সেটা যদি সফল হয় সেখানেই আমাদের সাফল্য।

‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ মেনে এ বিচারের রায় হয়েছে দাবি করে তাজুল বলেন, আমরা এটিও একই সাথে বলতে চাই, যে কোয়ালিটি অফ এভিডেন্স এখানে দেখানো হয়েছে, যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যেকোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজকে যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই সেই শাস্তি পাবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা মনে করি শহীদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিশোধের স্বার্থে এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায় প্রশান্তি আনবে, ভবিষ্যতের প্রতি একটা বার্তা, বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ মামলার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যু ছিল না বলে ওই বিষয়ে তারা (ট্রাইব্যুনাল) কোনো কমেন্টস করেননি। শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশে থাকা সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রায় বাস্তবায়ন কিভাবে হবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘রায় বাস্তবায়ন আইনি পথেই, আইনসঙ্গতভাবেই হবে। বেআইনি বা আইনসঙ্গত নয় এমন পথ সরকার অবলম্বন করবে না।’

আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক শেখ হাসিনা এ মামলার শুনানিতে সরাসরি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেনও তাকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমির হোসেন বলেন, ‘রায়টা আমার পক্ষে হয়নি, বিপক্ষে গেছে। এ জন্য আমি ক্ষুব্ধ। কষ্ট লালন করতেছি। আসামিদের ফাঁসির রায়ে আমি কষ্ট পেয়েছি।’

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষের গণ-আকাক্সক্ষা ছিল এই রায়, ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের আগে করে যাবেন- এটি আমাদের দাবি ছিল। সেটি পূরণ হয়েছে।’

ট্রাইব্যুনাল আইনে কিভাবে এ বিচার : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারের কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গত বছরের ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে তিনি ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতা ও সহযোগীদের বিচারের আইনি যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি সেদিন বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের অধীনে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।

এ আইনটি করা হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। এ ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে বিচারের আওতায় আনা এবং স্বাধীনভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনার বিধান যুক্ত করে ২০০৯ সালে আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমেই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩(১) ধারায় বলা আছে, আইনের দুই নম্বর উপধারায় উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী [বা সংস্থা] বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তার বিচারের এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনিভা কনভেনশন বিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচারের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়েছে।

কী ছিল অভিযোগ : চলতি বছরের ১২ মে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরপর ১ জুন প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দফতরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এবং যাবতীয় দলিল জমা দেয়। পরে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্র বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। এ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয়।

গত ১০ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ অভিযোগে শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-১। সেই সাথে মামুনের রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করা হয়।

অভিযোগ-১ : গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রদান এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ মাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ; যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত।

অভিযোগ-২ : আসামি শেখ হাসিনার ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ এবং এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি সহায়তা, সম্পৃক্ততা ও ষড়যন্ত্র করেন।

অভিযোগ-৩ : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচণা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগ-৪ : ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগ-৫ : ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ছয় ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

গত ৩ আগস্ট প্রসিকিউশন প্রারম্ভিক বিবৃতি (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) দেয় এবং ৪ অগাস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক শেষে ২৩ অক্টোবর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানায়, এ মামলার রায় হবে ১৭ নভেম্বর।

প্রসিকিউশনের প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে এ মামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় তার সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর মো: মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহম্মদ, মো: আবদুস সোবহান তরফদার, মো: সহিদুল ইসলাম সরদার, তানভীর হাসান জোহাসহ প্রসিকিউশন দল।

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন যায়েদ বিন আমজাদ। আর শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন শুনানি করেন।

সাক্ষীরা কে কী বলেছিলেন

এ মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক আবু সাঈদের বাবা, নিহতদের পরিবারের সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, জুলাই আন্দোলনের আরেক নেতা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। বদর উদ্দীন উমরের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে, যা তিনি মৃত্যুর আগে লিখে পাঠিয়েছিলেন।

এ ছাড়া রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই ২০২৪-এ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করে জানায় যে, শেখ হাসিনা আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারে করে হামলার বিষয়ে মামুন বলেন, ‘প্রতিবাদকারীদের এলাকা ভাগ করা হয়েছিল। তারপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র ও সাধারণ বেসামরিক অনেককে হত্যা ও জখম করা হয়।’

এই মামলার ৪ নম্বর অভিযোগ হলো রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা। এ মামলায় ১৬ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, যিনি আন্দোলনের সামনের সারির ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৪০০ জনকে হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখন আমরা বিভিন্নভাবে তালিকা পাচ্ছি। এর আগে আমরা আরো দু’টি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি, যেটি বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড। শত শত মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে আর ফিরে পাওয়া যায় নাই। আমরা আয়নাঘর প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং প্রত্যেকটা ঘটনায় প্রত্যেকটা ভিকটিমের জন্য যদি আপনি একবার করে বিচার করতে যান, তাহলে এই বিচার হয়তো কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না।

মাহমুদুর রহমান সাক্ষ্যে বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তৎকালীন সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ সেনাসদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করবার কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং দুই দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্যে বলেন, ছাত্রদেরকে রাজাকারের বাচ্চা এবং রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করায় সমগ্র দেশের ছাত্রছাত্রীরা অপমানিত বোধ করে।

ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট’-এর ৭ অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, যেখানে ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যাটাক’ এবং ‘সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাকের’ কথা বলা আছে। এ দুই ধরনের অপরাধ শেখ হাসিনা করেছেন।

অন্য দিকে শেখ হাসিনার আইনজীবী মো: আমির হোসেন যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে মূল এভিডেন্স অ্যাক্ট. প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সিআরপিসিও এ আইনে গ্রহণ করা যায় না। এ আইনে বিচার মানে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে আসামিকে বলা হবে, ‘এখন সাঁতার কাটো’।’

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘যদি ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনকে বৈধও ধরে নেয়া হয়, সেই আন্দোলনকেও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে।’

এ আইনজীবীর ভাষ্য, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেগুলো মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর শুরু থেকে এগুলো হয়ে আসছে। ইরানের খোমেনি, মালয়েশিয়ার মাহথির মোহাম্মদ করেছেন। শুধু বেঠিকটাকে প্রাধান্য দেবেন, সঠিকটাকে দেবেন না- তা তো হবে না।’