৫ ব্যাংক একত্রীকরণের উদ্যোগ

আমানতকারীদের ত্রাহি অবস্থা

পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট মিটছে না।

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition
  • উদ্যোক্তাদের মালিকানা টিকিয়ে রাখার কসরত
  • ৩ ব্যাংক সম্মত হলেও ২ ব্যাংকের অস্বীকৃডু

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাটের কারণে আমানত শূন্য হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোতে আমানতকারী ও ব্যাংকারদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কষ্টের জমানো অর্থ ফেরত না পেয়ে প্রতিনিয়তই ব্যাংকার ও গ্রাহকদের মধ্যে বচসা চলছে। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট মিটছে না। এমনি পরিস্থিতিতে পাঁচটি ব্যাংককে প্রাথমিকভাবে একত্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উদ্যোগের চূড়ান্ত রূপ নিতে একবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ব্যাংকাররাও গ্রাহকদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন একীভূত করণের বিষয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগকে তিনটি ব্যাংক সরাসরি সমর্থন করলেও দু’টি অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আর এরই মাধ্যমে গতকাল শেষ হয়েছে পাঁচ ব্যাংকের শুনানি কার্যক্রম।

জানা গেছে, পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একত্রীকরণের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দাবি করা হচ্ছে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, এ জন্য তাদেরকে সময় দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

বাস্তব পরিস্থিতি : বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত আওয়ামী লুটপাটের অন্যতম জায়গা পরিণত হয়েছিল। আর এসব লুটপাটের মাধ্যম ছিল মাফিয়া এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, সালমান এফ রহমানসহ আওয়ামী সমর্থিত ব্যবসায়ী ও ব্যাংক পরিচালকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী একমাত্র মাফিয়া এস আলমই ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়েছে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের লুটপাটের কারণে ডজন খানেক ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এর মধ্যে আলোচ্য পাঁচটি ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে বিপুল অঙ্কের তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে, ব্যাংকটি থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে এস আলম সরাসরি নিয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৯৮ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে শুনানি শেষে বলেছেন, এস আলম এ ব্যাংক থেকে সরাসরি ২৮ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যাদের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকটির এখন খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। তেমনি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ব্যাংক ডাকাত এস আলম একাই নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ টাকার জোগান : বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংককে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা, এসআইবিএলকে ছয় হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে দুই হাজার ২৯৫ কোটি টাকা ও ইউনিয়ন ব্যাংককে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার নগদ টাকা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকগুলো কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

ব্যাংক গ্রাহক বিপাকে : ব্যাংকগুলোতে এ লুটপাটের কারণে সাধারণ গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকাররা। সাধারণ গ্রাহকের দাবি হলো, তারা অনেক কষ্টের অর্থ এসব ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন। অনেকেই সারা জীবনের চাকরির পেনশন এসব ব্যাংকে রেখেছিলেন। মাস শেষে মুনাফা দিয়ে তারা চলতেন। এখন মুনাফা তো দূরের কথা, আসলই ফেরত পাচ্ছেন না। অনেকেই মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমা করেছিলেন। নানাভাবে ব্যাংকগুলোতে অর্থ সঞ্চয় রেখেছিলেন গ্রাহকরা। এখন তারা তাদের অর্থ ফেরত চাচ্ছেন। তবে, ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করেছে এস আলম। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও এর প্রতিরোধে কিছু করেনি। এখন ব্যাংকে কোনো নগদ অর্থ নেই। কেউ আমানতও রাখছে না। সবাই টাকা ফেরত নিতে চাচ্ছেন। তারা কিভাবে টাকা ফেরত দেবেন। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে বচসা হচ্ছে। একজন ব্যাংকার অসহায় অবস্থায় বলেন, তিনি আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকে অর্থ এনে ব্যাংকে রেখে ছিলেন। কিন্তু এখন তাদের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। বাসায় থাকলে আত্মীয় পরিজনের চাপ, আর অফিসে আসলে সাধারণ গ্রাহকের চাপ। এ নিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন তারা। তারা অনুরোধ করেন, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অচিরে যেকোনো একটি উদ্যোগ নেবেন। তাদেরকে উদ্ধার করবেন।

একীভূত হতে রাজি, নারাজি : বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশী অডিট ফার্ম ও নিজস্ব টিম দিয়ে ব্যাংকগুলোতে একাধিক অডিট করানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক, যে তারা কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য ব্যাংকগুলো একীভূত করে একটি শক্তিশালী ব্যাংকে রূপান্তর করা গেলে গ্রাহক যেমন তাদের অর্থ ফেরত পাবেন, তেমনি ব্যাংকগুলোর শক্ত একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। এ জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকার জোগান দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগকে অনুরোধও করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। ব্যাংকগুলোর একীভূত করতে বিদায়ী সপ্তাহে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর সাথে বৈঠক করেছে। বৈঠকগুলোতে তিনটি ব্যাংক একীভূত হতে সরাসরি রাজি হয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একপক্ষ অর্থ পুনর্গঠিত বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে একমত হলেও উদ্যোক্তা পরিচালকরা এক্ষেত্রে নারাজি দিয়েছেন। তাদের দাবি হলো, ব্যাংকটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে এক্সিম ব্যাংক সরাসরি একীভূত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তবে তাদেরকে দুই বছরের সময় দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।

সাধারণের দাবি হলো, তাদের কষ্টের আমানত কিভাবে ফেরত দেবে সেই উদ্যোগ নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। মালিকানা নিয়ে যারা ঝগড়া করছেন তারা তাদের মালিকানা টিকিয়ে রাখার জন্য যা করণীয় তা করতে আপত্তি নেই। সাধারণ গ্রাহক চান তাদের কষ্টের আমানত ফেরত দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। গত এক বছর যাবৎ তারা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে বলে তারা মনে করছেন।