প্রযুক্তিই কমাতে পারে বজ্রপাতে প্রাণহানি

আব্দুল কাইয়ুম
Printed Edition

  • বিশ্বে মৃত্যুর ৪ ভাগের ১ ভাগ বাংলাদেশে
  • বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক, জেলে
  • বছরে ঝরছে ৩০০ প্রাণ

মিতালি ত্রিপুরা গত মঙ্গলবার ঘরের বারান্দায় শুয়ে শিশু সন্তানকে দুধপান করাচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ করে বজ্রপাত হলে মিতালি ত্রিপুরা ও শিশু ডেভিড চাকমা বিদ্যুতায়িত হন। পরে ঘরের অন্য সদস্যরা এগিয়ে এসে দেখেন মা ও শিশু দু’জনেই নিথর পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মা মিতালি ত্রিপুরার জ্ঞান ফিরলেও শিশু ডেভিড আর জেগে ওঠেনি। হঠাৎ বজ্রপাত কেড়ে নিলো মায়ের কোলে থাকা শিশু ডেভিডের প্রাণ। একই দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে বজ্রপাত থেকে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে ৮ দোকান।

চলতি মাসে সিরাজগঞ্জের তাড়াশের সাস্তান গ্রামে বজ্রপাতে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্র প্রাণ হারায়। সাতক্ষীরার আশাশুনিতে এক রাজমিস্ত্রি নিহত হয়েছেন। দিনাজপুরের হিলিতে বজ্রপাতে এক নারীর মৃত্যু হয়। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে এক নারী মারা যান। বিলে মাছ ধরতে গিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে এক কৃষকের। সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায় হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে একজন এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ও নান্দাইলে আলাদা বজ্রপাতে দুই গরুসহ এক কৃষক ও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতে এক হাঁসের খামারি নিহত হয়েছেন। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় মায়ের সাথে গরু আনতে গিয়ে ১০ বছর বয়সী সন্তান নিহত হয়েছে। শেরপুর জেলার এক কৃষক ও নালিতাবাড়ীতে এক বৃদ্ধা বজ্রপাতে মারা গেছেন। চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তরে বজ্রপাতে এক স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশায় বজ্রপাতে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে।

কয়েক বছর ধরে দেশে বেড়ে চলেছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে বছরে গড়ে প্রাণ হারান ৩০০ জন। ভবিষ্যতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে, বজ্রপাতের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। একটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ২৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে, যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। মোট বজ্রপাতের ৩৩ শতাংশই ভূমিতে আঘাত করে। এতে করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঠে কাজ করা কৃষক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের ১৫টি জেলায় বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। তার মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ অন্যতম।

তবে এই ধরনের দুর্যোগ থেকে বাঁচতে আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই যন্ত্র তার চারপাশের ৪০০ মিটার এলাকায় কোনো বজ্রপাত হলে তা মাটিতে নামিয়ে ফেলে। এতে করে সেই এলাকার কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ২০১৯ সালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৭৫০টি যন্ত্র স্থাপন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেই বছরের পর বজ্রপাতে কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি।

বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দু’টি ইউনিয়নে দু’টি ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ যন্ত্র স্থাপন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে বজ্রপাত নিরোধক এই যন্ত্র স্থাপনের ফলে স্থানীয়রা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কারণ এটির চার দিকের ৪০০ মিটারের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা নিজের দিকে টেনে মাটিয়ে পাঠিয়ে দেয়। স্থানীয়রা জানান, গত দুই বছর ধরে যন্ত্রটি স্থাপনের পর এলাকাটিতে বজ্রপাতে কেউ মারা যায়নি।

একই ইউনিয়নের গোবরখলা গ্রামের শিক্ষার্থী জুবায়ের তালুকদার জানান, আগে বজ্রপাতে অনেক লোক মারা গেলেও গত দুই বছর যাবৎ যন্ত্রটি স্থাপন করার পর এ অঞ্চলে বজ্রপাত হয়নি। এতে করে স্থানীয় লোকজন সুরক্ষিত আছে। এটি খুবই সুবিধাজনক যন্ত্র। এটি স্থাপনে মাত্র একটি খুঁটির দরকার। সেখানে জমি নষ্ট হয় না। এর ফলে বৃষ্টির মধ্যেও কৃষকরা মাঠে কাজ করতে পারছে।

আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল যন্ত্রটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সিইও মো: মাহমুদুর রহমান বলেন, এ ডিভাইসটির চার দিকে ৪০০ মিটার এলাকায় বজ্রপাত হলে তা নিজের দিকে টেনে নিয়ে মাটিতে নামিয়ে ফেলে। সঠিকভাবে যতœ নিতে পারলে এটি দীর্ঘ দিন ব্যবহার করা যায়। যন্ত্রটি সোলার থেকে চার্জ নেয়ায় আলাদা বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে না। ই-সিমের কারণে সরাসরি ডাটাগুলো পাওয়া যায়। যেকোনো স্থানে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারে এর কার্যক্রম মনিটরিং করা যায়। আইওটি সলিউশন ও জেনারেল দুই ধরনের যন্ত্রই রয়েছে।

আমরা দেশের প্রতিটি বিমানবন্দরে, ওয়াসা, পিডব্লিউডি ও বিমানবাহিনীর অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে এ সিস্টেম স্থাপন করেছি। তা ছাড়া দুর্যোগ অধিদফতরও তারা কিছু কিছু স্থানে এই যন্ত্র স্থাপন করেছে। এ ডিভাইসটি আলাদা আলাদ ছয়টি মডিউল দিয়ে একটি ডিভাইস। তার মধ্যে পাঁচটি বিকল হয়ে গেলেও একটি দিয়ে পুরো কাজ চলবে। এটির প্রটেকশন নিজের মধ্যেই রয়েছে।

আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিজনেস হেড হাসিনা আক্তার বলেন, আমাদের ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ বজ্রপাত হলে ড্যাস বোর্ডে ই-মেইলে সব ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আর তথ্য জমা থাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত। এ প্রযুক্তি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপন করেছে। সেখানেও তারা ভালো ফলাফল পাচ্ছে। সরকার বজ্রপাতের সময় ও স্থান চিহ্নিত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। অথচ আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন বজ্রপাতে কৃষক, শ্রমিকদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের (রাইমস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব জেলাগুলিতে এপ্রিল ও মে মাস সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হয় এবং এর কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে কৃষক। একটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ২৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ। একটি সাধারণ বজ্রপাতে ৩০ কোটি ভোল্ট ও ৩০ হাজার অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, যেখানে সাধারণ বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ মাত্র ২২০ ভোল্ট ও ১৫ অ্যাম্পিয়ার। মোট বজ্রপাতের ৩৩ শতাংশই ভূমিতে আঘাত করছে।

আবহাওয়াবিদরা বলেন, দেশে রোগবালাই, খরা, বৃষ্টি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যায় বজ্রপাতে। এসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক। বজ্রপাতের সর্বশেষ শব্দ শোনার পর থেকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে হবে। বাইরে কাজ করা অবস্থায় আশ্রয়ের জায়গা না থাকলে, মাটিতে গুটিশুটি হয়ে বসতে হবে; কোনো অবস্থাতেই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। বজ্রপাতের সময় কোনো উঁচু স্থানে অবস্থান করা যাবে না। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে অতিদ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

বজ্রপাত সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম ফারুখ বলেন, বজ্রপাতে বিশ্বের চার ভাগের একভাগ মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে কৃষক ও জেলে। হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ ভৌগোলিক। তা ছাড়া শীতের পরপর এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে মে মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু হয়। তাপমাত্রা বাড়লে মেঘ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর মেঘে বজ্রপাত হয়। আলাস্কা ও কানাডায় প্রচুর বজ্রপাত হতে দেখেছি। তাদের প্রচুর সেন্সর আছে। এসব সেন্সর দিয়ে বজ্রপাত সরাসরি মাটিতে নামিয়ে আনা হয়। আর এসব হিট ও ইলেকট্রিসিটি রূপান্তর করে গৃহাস্থলি ও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করে দেয়। বজ্রপাতের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে বলেন, বজ্রপাতে প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন থাকে। মাটিতে বজ্রপাত হলে নাইট্রোজেনের আধিক্য বাড়ে- এটি ফসলের জন্য ভালো।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা বিটিআরসি, বিএমডি ও এলজিআরডির সাথে মিলে সচেতনতামূলক কাজ করছি। যাতে বজ্রপাতের আগে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় মোবাইলে এসএমএস প্রেরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালিয়ে থাকি। এটি আরো বৃদ্ধি করা হবে। তবে আমরা বজ্রপাত নিরোধক স্থাপনাও তৈরি করছি। যাতে কৃষক, শ্রমিক, জেলেরা সেসব ঘরে গিয়ে বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নিতে পারে।