‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ রাষ্ট্র, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মৌলিক পুনর্গঠন প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মূল প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রভাষা থাকবে বাংলা; তবে সংবিধানে সব মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেয়া হবে। নাগরিক পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশী’। দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ ও উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব হবে না। প্রস্তাবনাসহ কিছু অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধকতা রাখা হবে। একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসানে সংবিধান বিলুপ্তি বা স্থগিতকরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পুনর্বিবেচনা ও সীমাবদ্ধতা অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি : ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় সম্প্রীতি’কে মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন সংবিধান কাঠামো গঠনের উদ্দেশ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া নথিতে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব উঠে এসেছে। এর মধ্যে আরো রয়েছে দ্বিকক্ষীয় সংসদ ব্যবস্থা, উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক (পিআর) নির্বাচন, নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের সংরক্ষণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নতুন ধারা।
বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঐতিহাসিক ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’- যা স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক ঐকমত্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
স্বাক্ষরের জন্য দলগুলোকে পাঠানো হলো চূড়ান্ত জুলাই সনদ : স্বাক্ষরের জন্য ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে চূড়ান্ত জুলাই সনদ পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোকে চূড়ান্ত সনদ পাঠায় কমিশন। এতে বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। আগের মতোই সনদে ৮৪টি বিষয় (নোট অব ডিসেন্টসহ) উল্লেখ আছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার আগের মতোই রয়েছে।
গতকাল জাতীয় সংসদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সনদ স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অন্যান্য সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। তবে দলগুলোকে পাঠানো গত ১০ সেপ্টেম্বরের সনদে ৫ নম্বরে ‘ঐকমত্যে উপনীত হওয়া বিষয়সমূহ’ থাকলেও গতকাল পাঠানো সনদের ৫ নম্বরে ‘ঐকমত্যের ঘোষণা’ নামে নতুন একটি বিষয় যোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে- (ক) বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশিব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নলিখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীতি হয়েছি; (খ) এসব বিষয়কে এই জাতীয় সনদে (কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ) সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি এবং (গ) ২০০৯ সাল পরবর্তী ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ, গ্রেফতার ও কারাবরণকারীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং ওই গণ-অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হিসেবে ঘোষণা করছি।
অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো সনদে উল্লিখিত কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত প্রকাশ করলেও জাতীয় সনদে সব কিছুই সন্নিবেশিত করতে সম্মত বলে অঙ্গীকার নেয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
পটভূমিতে কিছু শব্দ ও বাক্যের পরিবর্তের পাশাপাশি কিছু তথ্য সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের কালরাত, গণহত্যার বিষয়টি যোগ করা হয়েছে। আগে ছিল ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। চূড়ান্ত সনদে ১৯৭৮ সালে (জিয়াউর রহমানের) বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগের ফলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন যোগ করা হয়েছে। সনদে জায়গা পেয়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের পল্টনের লগি-বৈঠার তাণ্ডব ও ১/১১ সরকারের কথাও। আগে ছিল ফ্যাসিস্ট শাসক, সেখানে শেখ হাসিনার নামটাও যোগ হয়েছে।
আগামী শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় রাজনৈতিক দলগুলোর দু’জন করে প্রতিনিধি আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে নেতৃত্ব দেবেন।
গণ-অভ্যুত্থান থেকে জাতীয় সনদে : ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানি নিপীড়ন, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তী ৫৩ বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র বারবার পদদলিত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কে কমিশন উল্লেখ করেছে ‘ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের যুগ’ হিসেবে, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয়করণ, নির্বাচনী প্রহসন, বিচারহীনতা ও দমননীতির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়। এ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছরের গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ছিল ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান; যেখানে ছাত্র-শ্রমিক-নারী ও প্রবাসীদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে।
সংস্কারের ছয় কমিশন ও ঐকমত্যের ভিত্তি : অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন এই ছয়টি বিষয়ে পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলো ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তাদের সুপারিশ জমা দেয়। এর পর ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার কাজ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে সংস্কারপন্থা নির্ধারণ করা।
ছয় মাসব্যাপী আলোচনায় ৩৩টি রাজনৈতিক দল মতামত দেয়; তাদের মধ্যে ৩০টি দল মূল বিষয়গুলোতে একমত হয়ে এই ‘জুলাই সনদ’ অনুমোদন করে।
সনদের মৌলিক প্রস্তাব বহু জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি : সংবিধানে বাংলাদেশের বহুজাতি, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি চরিত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্বিকক্ষীয় ভোট : আইনসভার দুই কক্ষের যৌথ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান এবং রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রস্তাব। জরুরি অবস্থা সীমিতকরণ : ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সীমিত জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান।
কমিশনের মতে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ‘গণতান্ত্রিক চুক্তি’, যা একটি নতুন সামাজিক সাংবিধানিক ধারা নির্মাণের ভিত্তি। সনদের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হলো, যার লক্ষ্য- ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী ন্যায়ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, এই সনদ অনুযায়ী ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে তোলা হবে। এ বিষয়ে সব দলের লিখিত মতামত সংরক্ষিত থাকবে ‘জাতীয় ঐকমত্য রিপোর্ট’-এর অংশ হিসেবে।
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ কেবল একটি নীতিপত্র নয়; এটি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক আত্মা ও সাংবিধানিক রূপান্তরের সেতুবন্ধন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নতুন করে সংজ্ঞায়িত হতে যাচ্ছে- দলীয় ক্ষমতার বাইরে এক জনগণনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকনির্দেশনা হিসেবে।
নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা : সনদের ১৩ থেকে ১৫ ধারায় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশন প্রার্থীদের মনোনয়ন যাচাই, বাতিল ও অনিয়ম তদন্তের পূর্ণ এখতিয়ার পাবে। নির্বাচনী অভিযোগ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত কমিশনের চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
কমিশন নিজস্ব অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনার স্বাধীনতা পাবে; যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর স্বায়ত্তশাসন আরো শক্তিশালী করবে।
নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক কাঠামো : প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৯০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে। মেয়াদ শেষের কমপক্ষে ২০ দিন আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কমিশন প্রয়োজন অনুযায়ী ‘বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামো’ গঠন করে নির্বাচন তদারকির ক্ষমতা রাখবে।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ : খসড়ার ১৬ নম্বর ধারায় ‘প্রাদেশিক প্রশাসন’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘স্থানীয় প্রশাসনিক আইন’ প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও সিটি পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ ও আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বাড়বে। এটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পরিবর্তে স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতায়িত করার একটি মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা : সনদের ১৮ থেকে ২১ ধারায় একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হবে জনপ্রতিনিধি পরিষদ, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত এবং অন্যটি জাতীয় পরিষদ- আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনে গঠিত।
জাতীয় পরিষদের ১০০টি আসনের মধ্যে অর্ধেক সরাসরি নির্বাচিত, বাকি অর্ধেক দলীয় ভোটের আনুপাতিক তালিকা অনুযায়ী পূরণ হবে। দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব : খসড়া অনুযায়ী নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। এই সংরক্ষণ সরাসরি নয়, বরং ঘূর্ণায়মান ও আনুপাতিক ভিত্তিতে কার্যকর হবে; যাতে সব দলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।
অর্থনৈতিক ও নীতিগত কমিশন গঠন : চূড়ান্ত ধারাগুলোয় জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একটি অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনা কমিশন জাতীয় উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন এবং জনগণনির্ভর অর্থনৈতিক নীতির জন্য জবাবদিহিমূলক কাঠামো তৈরি করবে।
সনদে এই কমিশনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশও রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাংলাদেশে দলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসান ও জনগণনির্ভর শাসনব্যবস্থার সূচনা করতে পারে। দ্বিকক্ষীয় সংসদ, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, নারী-সংখ্যালঘু অন্তর্ভুক্তি এবং বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন- এই চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়াতে যাচ্ছে দেশের নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, এ খসড়াটি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সংগ্রহ শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে একটি ‘নতুন প্রজাতান্ত্রিক চুক্তি’) প্রতিষ্ঠিত হবে, যা ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শের সাথে সরাসরি সংযুক্ত।
সাংবিধানিক নিয়োগে বাছাই কমিটি প্রথা : ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাংবিধানিক পদগুলোতে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাছাই কমিটি প্রথা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই কমিটিগুলোর নেতৃত্ব দেবেন সংসদের স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার এবং এতে বিরোধী দলের প্রতিনিধি, প্রধান বিচারপতির মনোনীত বিচারপতি ও নাগরিক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ : প্রস্তাবিত বাছাই কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন স্পিকার, সদস্য হবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা এবং আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
কমিটি বিদায়ী কমিশনের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে প্রার্থীদের ‘ইচ্ছাপত্র’ ও জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করবে এবং যাচাই-বাছাই শেষে সর্বসম্মতিক্রমে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্ধারিত সংখ্যক কমিশনারের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে। রাষ্ট্রপতি তাদেরকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন।
সনদের খসড়া অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের জবাবদিহিতা এবং আচরণবিধি নির্ধারণে আইন প্রণয়ন করবে।
ন্যায়পাল নিয়োগ : সনদের ৩৯ ধারায় সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব আনা হয়েছে।
ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য গঠিত কমিটিতে থাকবেন- (১) স্পিকার, (২) ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে), (৩) সংসদ নেতা, (৪) বিরোধী দলের নেতা, (৫) দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রতিনিধি, (৬) রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি (নির্দলীয় যোগ্য ব্যক্তি) এবং (৭) আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
কমিটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন ন্যায়পাল প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। রাষ্ট্রপতি তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। ন্যায়পালের যোগ্যতা, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা সংসদ প্রণীত আইনে নির্ধারিত হবে।
২৫টি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবে সম্মত, তবে সাতটি দল (যেমন- জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট, প্রগতিশীল গণজোট) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সীমিত করার পক্ষে ভিন্নমত দিয়েছে।
সরকারি কর্ম কমিশন : প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশে তিনটি পৃথক সরকারি কর্ম কমিশন গঠন করা হবে; প্রতিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও সাতজন সদস্য।
নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটিতে থাকবেন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদীয় প্রধান ও বিরোধী হুইপ, প্রাসঙ্গিক সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রতিনিধি। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে মনোনীত প্রার্থীদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে।
কমিশনের সদস্যরা পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন এবং বিচারকের মতো অপসারণ সুরক্ষা ভোগ করবেন।
মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক : এই পদে নিয়োগের কমিটির নেতৃত্ব দেবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত)। সদস্য হবেন সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রধান হুইপ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি প্রমুখ।
কমিটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একজন প্রার্থী বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) : দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রস্তাব এসেছে। একটি বিশেষ বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি গঠিত হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি। সদস্য হবেন- একজন হাইকোর্ট বিচারপতি, মহাহিসাব-নিরীক্ষক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, সংসদ নেতা ও বিরোধী নেতা কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি এবং প্রধান বিচারপতি মনোনীত একজন নাগরিক প্রতিনিধি।
কমিটি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে। কমিশনে সর্বনিম্ন একজন নারী সদস্য রাখার প্রস্তাবও যুক্ত হয়েছে।
রাজনৈতিক ঐকমত্য ও ভিন্নমত : খসড়া সনদের ৩৯ থেকে ৪২ ধারার প্রস্তাবগুলোতে ২৩টি রাজনৈতিক দল পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে, তবে সাতটি দল ও জোট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রপতির ভারসাম্য নিয়ে ভিন্নমত দিয়েছে। বিশেষ করে ন্যায়পাল ও দুদকের কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করার পক্ষে তারা অতিরিক্ত প্রস্তাব দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রস্তাবিত কাঠামো কার্যকর হলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ বাছাই প্রথা’-এর আওতায় আসবে। এটি প্রশাসনিক সংস্কার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি ভারসাম্যপূর্ণ নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করবে।